নওগাঁয় বন্যায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

বন্যায় আত্রাই নদের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে নওগাঁর নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি। বৃহস্পতিবার সকালে মান্দা উপজেলার খোদ্দ বান্দাইখাড়া এলাকায়
প্রথম আলো

নওগাঁর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার আত্রাই নদের পানি কমতে শুরু করলেও পানি বাড়ছে ছোট যমুনা নদীর। আর আত্রাই নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙন দিয়ে এখনো তীব্র স্রোতে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকায় পানি আরও বেড়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।

বৃহস্পতিবার নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আরিফুজ্জামান খান জানান, গতকাল বুধবার থেকে আত্রাই নদের পানি কমতে শুরু করেছে। তবে আজ দুপুর ১২টায় নওগাঁর মান্দা উপজেলার জোতবাজার পয়েন্টে আত্রাই নদের পানি বিপৎসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে ওই পয়েন্টে আত্রাই নদের পানি বিপৎসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ২৪ ঘণ্টায় আত্রাই নদের পানির উচ্চতা কমেছে ৫৪ সেন্টিমিটার। পানি বাড়ছে ছোট যমুনা নদীতে। দুপুরে নওগাঁ শহরের লিটন ব্রিজ পয়েন্টে ছোট যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল একই সময়ে এই পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়।

স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর পানি বেড়ে দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে পড়েছে নওগাঁর নিম্নাঞ্চলের মানুষ। এক সপ্তাহ ধরে জেলার আত্রাই, মান্দা, রানীনগর ও নওগাঁ সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। মান্দা ও আত্রাই উপজেলায় আত্রাই নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আগের ভাঙন স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢোকা অব্যাহত থাকায় ওই দুই উপজেলার নিম্নাঞ্চলে পানি বেড়েছে। বুধবার রাতে পানির তোড়ে মান্দার দেলুয়াবাড়ি-কালিকাপুর সড়ক ভেঙে কালিকাপুর ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। ওই এলাকার মানুষের চলাচলের প্রধান ওই সড়কটি ভেঙে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় মানুষ।

দুর্ভোগে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। বৃহস্পতিবার সকালে নওগাঁর মান্দা উপজেলার খোদ্দ বান্দাইখাড়া এলাকায়
প্রথম আলো

আজ সকাল আটটা থেকে দুপুর পর্যন্ত মান্দা উপজেলার নুরুল্যাবাদ ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বন্যাকবলিত পার নুরুল্যাবাদ, সুরহট্টি, খোর্দ্দ বান্দাইখাড়া ও চকরামপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনেক মানুষের বসতঘর, রান্নাঘর ও উঠানে পানিতে তলিয়ে গেছে। উঠান ও ঘরে পানি থাকায় খাটের ওপর ও উঠানে উঁচু মাচান বানিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন মানুষ। পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে রান্নার কাজ করছেন অনেকে। সংকট দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির।

বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তাঁর ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের সব কটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানি প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ছে। সাত-আট দিন ধরে মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। গত জুলাইয়ে বন্যা ও চলতি বন্যায় মাঠের সবজি ও আমনের খেত ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। দুই দফা বন্যায় এলাকার সব শ্রেণিপেশার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। মানুষের আয়রোজগার নেই। সঞ্চয়ের টাকাও শেষ। গরিব মানুষেরা কোনোরকম ভাত সেদ্ধ করে লবণ ছিটিয়ে তা খেয়ে জীবনধারণ করে আছে।

বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দ বান্দাইখাড়া গ্রামের গৃহবধূ শেফালী বেগম বলেন, বন্যায় তাঁদের মাটির বাড়ি ধসে গেছে। পরিবার নিয়ে সাত দিন ধরে উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে নেই নলকূপ ও শৌচাগার। তিনি বলেন, ‘খাওয়ার কষ্ট তো হছেই। সবচেয়ে বেশি কষ্ট খাওয়ার পানি ও পায়খানা-প্রস্রাবের।’

বানভাসি অন্যান্য মানুষের সঙ্গে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দাসপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাত-আট দিন ধরে এই এলাকার মানুষ অমানবিক পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করছেন। কিন্তু কেউ তাঁদের খোঁজখবর নিচ্ছেন না। এতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা না থাকায় তীব্র কষ্টে আছেন বানভাসি মানুষ।

এদিকে ছোট যমুনা নদীর পানি বাড়ায় নওগাঁ শহর রক্ষা বাঁধের বাইরে বের করে দেওয়ার নালা (আউটলেট) দিয়ে নদীর পানি শহরে ঢুকতে শুরু করেছে। এতে শহরের কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধের পূর্ব তীরের আউটলেট দিয়ে নদীর পানি ঢুকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নওগাঁ ব্যাটালিয়নের আবাসিক এলাকায় জলাবদ্ধতার দেখা দিয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা কামরুল আহসান বলেন, চলতি বন্যায় জেলার মান্দা, আত্রাই, রানীনগর ও সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের প্রায় ১৪ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে ১১০ মেট্রিক টন চাল ও ৩ হাজার ৯৪৫ ব্যাগ শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণসহায়তার জন্য আরও ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সামসুল ওয়াদুদ বলেন, বন্যায় ৫ হাজার ৫০৭ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে রোপা আমন ৫ হাজার ৪১১ হেক্টর ও ৯৬ হেক্টর জমির সবজিখেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।