নখের খোঁচায় উঠে যাচ্ছে দেয়ালের পলেস্তারা

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়নসহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় তৈরি বাড়ি। পূর্ব মৌকুড়ি গ্রাম, বালিয়াকান্দি সদর উপজেলা, রাজবাড়ীপ্রথম আলো

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলায় সরকারি ঘর দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, ঘরপ্রতি গড়ে ৪০–৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন সমিতির নেতারা। এরপরও ঘর তৈরির কাজও সেরেছেন কোনো রকমে। নখের খোঁচায় উঠে যাচ্ছে কোনো কোনো ঘরের দেয়ালের পলেস্তারা। তবে সমিতির নেতারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কিছু খরচ বাবদ তাঁরা কিছু টাকা নিয়েছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সূত্রে জানা যায়, বালিয়াকান্দি উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়নসহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ১৫টি টিনশেডের আঘাপাকা ঘরের জন্য বরাদ্দ পাওয়া যায়। প্রথম কিস্তিতে দুই কক্ষবিশিষ্ট ১০টি ঘরের প্রতিটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর দ্বিতীয় কিস্তিতে পাঁচটি ঘরের (দুই কক্ষের একটি টিনশেড ঘর, রান্নার স্থান ও শৌচাগার) জন্য বরাদ্দ ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা এই সুবিধা পেতে চান, তাঁদের সমিতির মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। সরকারি যেকোনো সহায়তা পেতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজনকে তাঁদের জন্য গঠিত সমিতির মাধ্যমে আবেদন করতে হয়।

সরেজমিনে সুবিধাভোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। কেউ দিনমজুর, কেউবা ভ্যানচালক। ভিটে ছাড়া আর কোনো জায়গাজমি নেই। তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেন, সমিতিগুলোর সভাপতিরা প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের সঙ্গে একটি অলিখিত চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের অন্তত ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে। এই টাকা ঢাকা থেকে বরাদ্দ আনাসহ নানাবিধ কাজে খরচ করা হবে। চুক্তির টাকা সর্বোচ্চ তিন কিস্তিতে দেওয়া যাবে। কিন্তু কাজ শুরু করার পর সভাপতিদের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। তাঁরা শ্রমিকদের খাওয়ানো, মালামাল পরিবহন, রং কেনা, সিমেন্ট কেনা, বকশিশ প্রভৃতি নানা কথা বলে টাকা নিতে থাকেন। বরাদ্দ পাওয়া এ ব্যক্তিরা আত্মীয়স্বজন, এনজিও থেকে ঋণ ও বাড়ির হাঁস–মুরগি বিক্রি করে টাকা দেন। প্রথম কিস্তির ঘরের কাজ শেষ হয়েছে। তবে দ্বিতীয় কিস্তির ঘরের কাজ চলছে।

পেশায় ভ্যানচালক ইসলামপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের নিরঞ্জন সরকার প্রথম কিস্তিতে ঘর পেয়েছেন। তাঁর চারজনের পরিবার। ঘরের জন্য তাঁকে প্রথমে ৪০ হাজার টাকা দিতে বলা হয়। পরে শৌচাগার, টিউবওয়েল দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছে আরও ৪০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। তিনি এনজিও ও আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মোট ৮০ হাজার টাকা দেন। এখন তাঁর প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার ২০০ টাকা কিস্তি। আবার ঘরের কাজও নিম্নমানের হয়েছে। ঘরের বিভিন্ন স্থানে গর্ত রয়ে গেছে। নখের খোঁচায় উঠে যাচ্ছে দেয়ালের পলেস্তারা।


পূর্বমৌকুড়ী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাজ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি সুশান্ত কুমার ওরফে পাইলট বলেন, ‘আমি ঘরের জন্য অত টাকা ঘুষ নিইনি। কাজ করতে আমার অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এ কারণে আমি বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করেছি। নিজের কাজ ফেলে এসব কাজ করেছি। সব মিলিয়ে আমার বেশ খরচ হয়েছে। এ কারণে পাঁচ-সাত হাজার টাকা নিয়েছি।’

জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় তিনটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানকার সমিতির সভাপতি বিনোদ সরকারের বিরুদ্ধে মোট ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘একটি ঘরে পিলার ভেঙে পড়েছিল। পিআইওকে বলে তা ঠিক করানো হয়েছে। আমি শুধু কার্তিকের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা সমিতির জন্য নিয়েছিলাম। বালিয়াকান্দিতে আসা-যাওয়ার কাজে, সমিতির কাজে তা খরচ করেছি। পাঁচ-ছয় মাস পরে ফেরত দিয়ে দেব।’

সভাপতি প্রদীপ দাস বলেন, ‘ঘর পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন আমার ভাই। বাকি দুজনের কাছ থেকে আমি ঘর দেওয়া বাবদ কোনো টাকা নিইনি। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে শুধুমাত্র নিরঞ্জনের কাজ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছি। এ ছাড়া সমিতির রেজিস্ট্রেশন ও সভা বাবদও টাকা–পয়সা খরচ হয়। আমি ওই টাকা পরে ফেরত দিতে চেয়েছি।’


ইউএনও এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বিষয়টি শুনেছি। সমিতির সভাপতিদের ডেকেছি। যদি কেউ অবৈধভাবে টাকা নিয়ে থাকে, তাহলে তা অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। কাজ চলার সময় বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেককেই কোনো প্রকার টাকা দিতে নিষেধ করেছি। অনিয়মের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’