নজিপুরে ইভিএমে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ

ভোটকেন্দ্রের বুথের সামনে ভোটারদের সারি। আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে নওগাঁর নজিপুর পলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে
প্রথম আলো

নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর পৌরসভা নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে) ভোটারদের নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নজিপুর সরকারি কলেজ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নজিপুর সিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদ্রাসার ভোটাররা অভিযোগ করেন, ইভিএমে আঙুলের ছাপ দিয়ে মেশিন খোলার পর আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকেরা নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করছেন।

নজিপুর সরকারি কলেজ কেন্দ্রে আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভোট দিতে এসেছিলেন হরিরামপুর এলাকার বাসিন্দা সাইফুর রহমান (৩৮)। ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি ভোট দিয়েছেন কি না, এই প্রশ্ন করতেই তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আর বইলেন না, ভাই। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে আঙুলের ছাপ দিতেই মেশিনে নাসহ আমার ছবি ভেসে উঠল। অমনি পাশ থাকা একটা লোক বাটন চাপ দিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে দিল। এরপর ওই লোকটা কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট দিতে কইল। নিজের পছন্দ মতোন ভোট দিতে পারমু না, এটা আগে জানলে ভোট দিতেই অ্যাসতু না।’

সাইফুর রহমান নামের ওই ভোটারের মতো আরও বেশ কয়েকজন ভোটার ইভিএমে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বিরুদ্ধে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা অথবা আঙুলের ছাপ দিয়ে মেশিনটি খোলা হলেও প্রতীকের নির্বাচনের বাটনে চাপ দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।

নজিপুর সিদ্দিকীয় ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের সামনে দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, কিছু মানুষ একটি জায়গায় জড়ো হয়েছেন। সেখানে একটা হইচই অবস্থা দেখে কাছে গিয়ে জানা গেল, এক ব্যক্তি ভোট দেওয়ার সব কাজ করেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে আঙুলের ছাপও দিয়েছেন। তবে মেয়র পদে পছন্দমতো তিনি ভোট দেওয়ার বাটনে চাপ দিতে পারেননি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এজেন্ট বাটন চাপ দিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে দিয়েছেন।

আনারুল ইসলাম নামের ওই ব্যক্তি বলেন, ‘এভাবে জোর করে বাটন চাপ দিয়ে ভোট দিয়ে নেওয়ার পরেও সেখানে দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কিছুই বললেন না। এটা পুরাই একটা ডাকাতি। এখানে কারও কাছে অভিযোগ করে লাভ নেই।’

আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ভোটারদের নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করার বিষয়ে জানতে চাইলে নজিপুর সিদ্দিকীয় ফাজিল মাদ্রাসার প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোহাইমিনুল ইসলাম বলেন, ‘একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ ধরনের কোনো অভিযোগ ভোটারদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তবে অনেক ভোটার ইভিএম বুঝে নেওয়ার জন্য সাহায্য চাচ্ছেন। তখন পোলিং এজেন্ট, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কিংবা প্রার্থীর এজেন্টরা গিয়ে তাঁদের সহায়তা করছেন।’

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নজিপুর সরকারি কলেজ, নজিপুর সিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদ্রাসা, নজিপুর পলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নজিপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ওই সব কেন্দ্রের কোনো বুথেই বিএনপি মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট নেই। ভোটকেন্দ্রের বাইরেই বিএনপির মেয়র প্রার্থীর কোনো কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিও চোখে পড়েনি। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীর উপস্থিতি দেখা গেছে সর্বত্র। কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে সব জায়গা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে।

বিএনপির মনোনীত মেয়র প্রার্থী আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, ‘৯টি কেন্দ্রের ৪৮টি বুথেই ধানের এজেন্ট দেওয়ার প্রস্তুতি ছিল। আজ সকালে ভোট শুরুর আগেই তাঁর এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকেরা তাঁদের বাধা দেন। ভোট শুরুর কিছু পর কেন্দ্রে ঢুকলেও প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা পরে এসেছিলেন বলে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে না দিয়ে বের করে দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশের দায়িত্বরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি। বিএনপির এজেন্ট না থাকার সুযোগে আওয়ামী লীগের সর্মকেরা ভোটারদের নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করছেন।’

বিএনপির এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়া ও ভোটারদের নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করার বিষয়ে জানতে চাইলে নজিপুর পৌরসভা নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পত্নীতলা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সময়মতো বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টরা কেন্দ্রে আসতে না পারায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা তাঁদের কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে দেননি। নির্বাচনী বিধি মেনেই এখানে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ভোটারদের কোনো নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করার যে অভিযোগ করা হচ্ছে, এটার ভিত্তি পাওয়া যায়নি।

বিএনপির প্রার্থী এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বুথে এ ধরনের অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সেখানে গিয়ে এ ধরনের ঘটনার কোনো সত্যতা পাননি।’

আজ সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্রগুলোতে বুথের সামনে ভোটারদের সারি চোখে পড়েছে। এ পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী রেজাউল কবির চৌধুরী ও বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আনোয়ার হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৩৫ জন ও ১২ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নজিপুর পৌরসভায় মোট ভোটার ১৬ হাজার ৯৯৭ জন।