নতুন স্বপ্ন দেখছে রোহিঙ্গারা

ত্রিপল দিয়ে ঘর তৈরি চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। বালুখালী সি ব্লক, উখিয়া, কক্সবাজার, ২৭ মার্চ দুপুর
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালীসহ পাঁচটি ক্যাম্প পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই ক্যাম্পগুলোতে বসতির মাধ্যমে নতুন স্বপ্ন দেখছে ক্ষতিগ্রস্থ রোহিঙ্গারা। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা সরকার এবং দেশি-বিদেশি সংস্থার সহযোগিতায় দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের টানা পাঁচ দিন দেওয়া হচ্ছে দুই বেলা রান্না করা খাবার।

ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের প্রাথমিকভাবে ত্রিপল ও তাঁবুতে ঠাঁই হয়েছে। আগামী দু–এক দিনের মধ্যে রোহিঙ্গারা নিজেরাই ঘর তৈরি করে বসতি করতে পারবে। প্রতিদিন তাদের দুই বেলা রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য তাদের কার্ড দেওয়া হবে। এরপর তারা নিজেরাই ঘর তৈরি করবে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শামসু-দ্দৌজা নয়ন বলেন, ‘বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাদের সাহায্য করছে। সবার সহযোগিতায় দ্রুত সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য কমিটি কাজ করছে।’

শরণাথী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, গত সোমবার উখিয়ার বালুখালীসহ ৫টি আশ্রয়শিবিরে আগুনে ১০ হাজার বসতি পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ৬ শিশুসহ অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। আহত হয় প্রায় ৪৫০ জন, গৃহহীন হয়েছিল ৪৫ হাজার মানুষ। নিখোঁজ ছিল অন্তত ৪০০ জন।

বালুখালী-৯ নম্বর ক্যাম্পে রোহিঙ্গা দলনেতা আবু তাহের বলেন, এ শিবিরে ৮ হাজার ৬০০ পরিবারে ৩৭ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। কয়েকটি ব্লক ছাড়া অধিকাংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ শিবির থেকে ৭ জন মারা গেছে। ১৯ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। ২৯৪ জন নিখোঁজ ছিল। এর মধ্যে অধিকাংশের খোঁজ পাওয়া গেলেও কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছে। পুড়ে যাওয়া বসতিতে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে রোহিঙ্গারা। নিজেদের বসতির ওপর ত্রিপল টাঙিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করছেন রোহিঙ্গারা।

আজ শনিবার সকাল ১০টায় বালুখালী-৯ নম্বর ক্যাম্পে দেখা গেছে, বসতি আর গাছপালা এখনো ছাইমাখা। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে তাবু ও ত্রিপলের ছাউনিতে। ধ্বংস্তূপের মধ্যেই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে সারি সারি তাঁবু। আর দ্রুত এই তাঁবুতে ঠাঁই হবে আগুনে পোড়া ঘরহারা রোহিঙ্গাদের। দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের সহায়তা। অগ্নিকাণ্ডের পর বড়ই সংকট ছিল খাদ্য, খাবার ও ব্যবহারের পানির। টয়লেট, জ্বালানি ও শিশুদের নিয়ে নানা ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব সংকট দূর করতে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসছে।

ত্রিপলের নিচে হাজারো রোহিঙ্গা
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় সরেজমিন বালুখালী-৯ ক্যাম্পে দেখা গেছে, আট শতাধিক তাবু তৈরির কাজ চলছে। সঙ্গে হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের ত্রিপলের নিচে ঠাঁই হয়েছে। প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে মাথা গোঁজার ঘর তৈরি করছে। কাঠফাটা গরমে নারী ও শিশুদের কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। কেউ কেউ ধ্বংসস্তুপের ওপর বসে সময় পার করছে।

কথা হয়, রোহিঙ্গা গৃহবধূ আমবিয়া বেগমের (২৭) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দিনে দুই বেলা রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। সকালের নাশতাও হয়নি কারও। সন্তানদের ভাত কিনে এনে খেতে দিয়েছি। নিজেরা রান্না করার মতো কোনো পাতিলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। হাতে কিছু জমানো টাকা ছিল, সেগুলো পুড়ে ছাই গেছে। (সাংবাদিক) জেনে বললেন, আসার সময় আমাদের জন্য কিছু সাহায্য–সহযোগিতা নিয়ে আসতেন।’

রোহিঙ্গা আলী আহমদ (৫৫) বলেন, আজ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ছয় দিন হচ্ছে। শুধু একটি বালতি, দুটি সাবান, ঘরের ছাউনির জন্য তিনটি বাঁশ, একটি ত্রিপল, একটি ঘুমানোর পাটি পেয়েছেন। কিন্তু রান্না করে খাওয়ার কিছুই নেই। নেই কোনো থালাবাসনও। বাঁশ ও ত্রিপল টাঙিয়ে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও খাবার ও পানির পাশাপাশি নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এরপরও নতুন বসতির মাধ্যমে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে রোহিঙ্গারা।

দুপুর ১২টায় বালুখালী ক্যাম্পের সি ব্লকে ঢুকে দেখা যায়, কয়েকজন শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ বসে আছে ত্রিপলের নিচে। কয়েক দিন আগেও এখানে তাঁদের ঘর ছিল। সেই ঘরসহ যাবতীয় মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। কোনো কিছুই আগুন থেকে রক্ষা করতে পারেনি।

নুর নাহার বেগম (৪০) বলেন, ‘তিন দিন খোলা আকাশের নিচে থাকার পর গত দুই দিন এখন নতুন করে ত্রিপলের নিচে ঠাঁই হলো। হাতে কোনো টাকাপয়সা না থাকায় এসব প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেও পারছি না। ব্যবহার ও খাবার পানির তীব্র সংকট।

একই শিবিরের বাসিন্দা আয়েশা বেগম (৩০) বলেন, ‘আগুনে পুড়ে গেছে সবকিছুই। স্বামী নেই, চার সন্তানসহ এখন বিধবা অবস্থায় আছি। সহায়–সম্বল এখন কিছুই নেই। এনজিও সংস্থার থেকে একটা ত্রিপল, চারটি বাঁশ দিয়ে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো। আমার ঘরে খাওয়ার পানি নেই, খাবার নেই, ছেলেমেয়েদের মুখে কোনো খাবার তুলে দেব, সে রকম অবস্থাও নেই। তাদের পরনে কোনো কাপড় নেই, মানবেতর জীবন যাপন করছি।’