নথিতে আছে, বাস্তবে নেই

বগুড়া শহরে বীর শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্টজনের নামে ৫৩টি সড়ক আছে। দোকান, বাসাবাড়ি, সাইনবোর্ডে সে নাম ব্যবহৃত হয় না।

কাগজে-কলমে বগুড়া শহরের সাতমাথা থেকে পার্ক রোড হয়ে ফুলতলা পর্যন্ত সড়কটির নাম শহীদ সাইফুল ইসলাম সড়ক। ১৯৭৪ সালের ৮ এপ্রিল এ সড়কের নামকরণ করে বগুড়া পৌরসভা। কিন্তু সড়কের কোথাও নেই নামফলক। শহরবাসীর কাছে সড়কটি পরিচিতি পেয়েছে গোহাইল রোড নামে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বগুড়া শহরের বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করা হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে। কিন্তু নামকরণ করেই দায় সারার কারণে শহীদ স্মৃতি রক্ষায় এই উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি। নেই নামফলকও। কারও মুখেও এসব সড়কের নাম শোনা যায় না।

অন্যদিকে স্থানীয় ব্যক্তিরা কিছু সড়কের নামকরণ শহীদদের নামে করলেও, তা পৌরসভার নথিতে নেই। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সড়কে শহীদদের নামফলক পুনঃ স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

পৌরসভার মেয়র, সচিব ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্র ছিলেন সাইফুল ইসলাম। ১৯৭১ সালে সাইফুল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে রণাঙ্গনে ফিরে আসেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি সারিয়াকান্দির হাটফুলবাড়ি এলাকায় কয়েকটি অভিযানে অংশ নেন। ১১ নভেম্বর রাতে শহরের ঠনঠনিয়ার বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে তাঁকেসহ ১৪ জনকে হত্যা করা হয়।

শহরের ডিসি বাংলো সড়কের প্রকৃত নাম শহীদ ছুনু সড়ক। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পৈতৃক বাড়ি জেলখানা মোড়ের ইলিয়াস প্রাঙ্গণ থেকে মহিলা ক্লাব পর্যন্ত অংশের নামকরণ করা হয় শহীদ খোকন সড়ক নামে। এ নামের ব্যবহারও কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।

বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, শহরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্টজনের নামে ৫৩টি সড়ক আছে। কিছু সড়কে নামফলক আছে। তবে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ করতে গিয়ে কিছু ফলক ভাঙা পড়েছে।

পৌরসভার নথি অনুযায়ী, ২০০৪ সালের ২৪ মার্চ শহরের খান্দার থেকে আবহাওয়া অফিসের সামনে দিয়ে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামমুখী সড়কটি ১৪ জন শহীদ স্মরণে শহীদ সরণি নামকরণ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এই সড়কের কোথাও নামফলক নেই। সড়কটি এখন ভিআইপি সড়ক নামে পরিচিত।

বগুড়া শহরের ভিএম স্কুল মোড় থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত (পুরোনো কোর্ট হাউস স্ট্রিট) সড়কের নাম ১৯৭৪ সালে শহীদ হিটলু নামকরণ করা হয়। ভিএম স্কুল মোড়ে একটি নামফলকও আছে। কিন্তু সড়কের কোনো সাইনবোর্ডেই শহীদ হিটলু সড়ক উল্লেখ নেই।

কণ্ঠশিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগম, জিনাত রেহেনা ও জেব-উন-নেসা জামালের বাবা প্রয়াত চিকিৎসক কছিরউদ্দিন তালুকদার ছিলেন বগুড়া জেলা মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি। তিনি সরকারি আজিজুল হক কলেজেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করাসহ পাকিস্তানবিরোধী সক্রিয় ভূমিকার জন্য ১৯৭১ সালের ২৯ মে কছিরউদ্দিন তালুকদারকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।

তাঁর নাম অনুসারে বগুড়া শহরের ১ নম্বর রেলগেট থেকে বাদুরতলা তিব্বতের মোড় পর্যন্ত শহীদ ডা. কছিরউদ্দিন সড়ক নামকরণ করা হয়। কিন্তু সড়কটি এখনো চকযাদু রোড নামে পরিচিত।

১৯৭১ সালে অস্ত্রাগার লুট করতে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে হামলা চালান মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিনের সম্মুখযোদ্ধা শহীদ আজাদ স্মরণে মালতিনগর মাটির মসজিদ থেকে চকলোকমান বটতলা পর্যন্ত অংশের নামকরণ করা হয় শহীদ আজাদ সড়ক। এটি পরিচিত ব্যাংক কোয়ার্টার সড়ক নামে।

পৌরসভার নথি অনুযায়ী, বাদুরতলা মোড় থেকে বাদুরতলা হাইস্কুল পর্যন্ত সড়কের কেতাবি নাম শহীদ মফিজ খন্দকার লেন রহমাননগর কাজীখানা থেকে মালতিনগর স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ মতিন সড়ক, ভাই পাগলার মাজারসংলগ্ন সড়কের নাম শহীদ কাবুল সড়ক। সান্তাহার সড়কের পশু সম্পদ কার্যালয়সংলগ্ন মোড় থেকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সংযোগ সড়কের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোকছেদ সড়ক, পুলিশ লাইনসের উত্তরের সড়কটির নাম মুক্তিযোদ্ধা সেন্টু সড়ক।

নাম আছে নথিতে নেই

শহরের দত্তবাড়ি থেকে উপশহরমুখী সড়কটি শহীদ তারেক সড়ক নামে পরিচিত। অনেক আগে স্থানীয় উদ্যোগে এখানে একটি নামফলক নির্মাণ করা হলেও, এখন তা নেই। অন্যদিকে সেউজগাড়ি পালপাড়া ইসকন মন্দির সড়কটি স্থানীয় উদ্যোগে শহীদ বুদ্ধিজীবী মহসিন আলী দেওয়ান সড়ক নামে নামকরণ করা হলেও পৌরসভা নথিতে নেই।

বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তৌফিক হাসান বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্যসন্তান। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বীরত্বগাথা তুলে ধরতে সড়কের নামকরণের পাশাপাশি ফলক নির্মাণ জরুরি। এ ছাড়া বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচিতিমূলক সাইনবোর্ডেও সড়কের নাম ব্যবহার করতে পৌরসভাকে উদ্যোগ নিতে হবে।