নদী শান্ত থাকলেই মনে শান্তি তাঁদের

নদীতে পানি বাড়লে তাঁদের ব্যস্ততার কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। প্রতিদিন ভোর, সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর পানির দিকে চোখ রাখতে হয়। দিনে চারবেলা আর রাতে একবেলা পরিমাপ করার পর মেলে কিছুক্ষণের স্বস্তি। এভাবে একেকটি দিন শেষে নতুন আরেক দিনের জন্য প্রস্তুতি চলে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপকদের (গেজ রিডার) নিত্যদিনের কর্মপ্রণালি এমন। সিলেট অঞ্চলের দুই প্রধান নদী ও সীমান্ত নদীগুলোর পানি বাড়ায় ঈদের দিনও নদীর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে কাটাতে হয়েছে সিলেটে পাউবোর ৯টি স্টেশনে কর্মরত ৯ জন পানি পরিমাপকের দিন। নদীর সুখেই যেন তাঁদের সুখ।

পাউবো জানায়, সিলেট অঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারা। সুরমার উৎপত্তিস্থল সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বরাক মোহনা। তবে সেখানে পলি পড়ায় ভারতের মেঘালয় থেকে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া দিয়ে নেমে আসা সুরমা নদীর একটি অংশে পানি পরিমাপ করা হয়। সেটির নাম কানাইঘাট পয়েন্ট। এ নদীর সিলেট শহর পয়েন্ট নামে আরও একটি স্টেশনে পানি পরিমাপ করা হয়। সুরমা সিলেট জেলার কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জের বাঘা, সিলেট শহর, বিশ্বনাথের লামাকাজি হয়ে সুনামগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত।

সুরমার পর সিলেট অঞ্চলের আরেক বড় নদী কুশিয়ারা। জকিগঞ্জের অমলসিদ থেকে এ নদী সিলেটের বিয়ানীবাজারের শেওলা, মৌলভীবাজার জেলার একাংশ শেরপুর হয়ে আবার সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, এরপর সুনামগঞ্জের রানীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলায়। এরপর একটি হাওর হয়ে এ নদী মিলিত হয়েছে মেঘনায়।

সুরমা-কুশিয়ারার পানির প্রবাহে বর্ষাকালে বড় রকমের ভূমিকা রাখে সিলেটের সীমান্ত নদী হিসেবে পরিচিত লোভা, সারী, ধলাই, পিয়াইন; ডাউকি, চেঙ্গেরখাল, গোয়াইনসহ প্রভৃতি নদ-নদী। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এসব নদীর উৎস। ওপারে ভারী বৃষ্টি হলে কিংবা পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ডধারী মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে টানা বৃষ্টি হলেই ঢল নামে সীমান্তের নদ-নদীতে। তখন সুরমা-কুশিয়ারার কূল উপচে পানি বসতি এলাকায় প্রবেশ করে বন্যা দেখা দেয়।

পাউবোর প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, এবারে বর্ষা মৌসুমে সীমান্ত এলাকার নদ-নদীতে মে মাস থেকে জুলাই পর্যন্ত চার দফা পাহাড়ি ঢল নেমেছে। বন্যা হয়েছে তিন দফা। সর্বশেষ ১৬ জুলাই থেকে তৃতীয় দফা বন্যা শুরু হয়। সুরমা-কুশিয়ারার অবস্থা তখন থেকে ছিল টইটম্বুর। চলতি সপ্তাহে পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে আসায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তবে ওপারে ভারী বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস থাকায় আবার ঢল নামার শঙ্কায় নদ-নদীর পানি পরিমাপকেরা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন নদ-নদীর ওপর।

পাউবোর অধীন সিলেট জেলায় পানি পরিমাপক (গেজ রিডার) পদে কর্মরত আছেন ৯ জন। তাঁদের সবার বাড়ি নদীর পানি পরিমাপক করার স্থানের আশপাশে। কুশিয়ারা নদীর অমলসিদ পয়েন্টে আবদুস সালাম, শেওলায় আবদুর রব, ফেঞ্চুগঞ্জে গিয়াস উদ্দিন, শেরপুরে জাহাঙ্গীর বখত, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ফেরদৌসী বেগম, সিলেট শহরে শহিদুল ইসলাম, লোভাছড়ায় নিরঞ্জন বৈদ্য, সারীঘাটে মো. আলাউদ্দিন ও ধলাই নদের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর পয়েন্টে মশিউর রহমান পানি পরিমাপক পদে কর্মরত।

অমলসিদের গেজ রিডার আবদুস সালাম ১৯৮৭ সাল থেকে এই পদে কর্মরত। অমলসিদেই তাঁর বাড়ি। স্ত্রীসহ আট সদস্যের বড় পরিবার। ঈদের দিন শনিবার সকাল ৯টায় তাঁর মুঠোফোনে কল দিলে সালাম জানান, সকাল ৬টায় দিনের শুরুতে প্রথম দফা পানি মাপতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। ঈদের জামাত পড়ে আবার ছুটে গেছেন অমলসিদ পয়েন্টে। দ্বিতীয় দফা পানি পরিমাপ করে বাড়ি ফিরছিলেন।

প্রায় ৩৩ বছর ধরে এ কাজ করায় নদীর পানির প্রবাহ যেন তাঁর জীবনেরই একটি অংশ হয়ে উঠেছে। সালাম বলেন, ‘আমরার ছুটিছাটা নাই। ১২ মাসই নদীর পানির লগে থাকতে অয়। ইবার ঈদটা বন্যার সময় পড়ায় বেশি সতর্ক। ডেইলি পাঁচবার পানির মাপ দিতে হয় ফোনে ও লিখিত আকারে। এর লাগি ঈদের দিনে ফুরসত নাই।’

ভারতের বরাক উপত্যকা থেকে নেমে আসা নদী বরাক। জকিগঞ্জের অমলসিদ এলাকায় বরাক মোহনায় সুরমা নদীর উৎপত্তিস্থল ধরা হয়। কিন্তু সেখানে পলি পড়ে চর হওয়ায় বর্ষকালে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ায় সীমান্ত নদী লোভার পানি পরিমাপ করে সুরমার পানির বিপৎসীমা নির্ধারণ করা হয়। লোভা নদীর পানি পরিমাপক নিরঞ্জন বৈদ্য জানান, সুরমায় পানি কমা আর বাড়ার বিষয়টি বর্ষাকালে লোভা নদী নির্ধারণ করে। এ জন্য লোভা নদীর পানি পরিমাপ করা হয় আলাদাভাবে। সেখানে পানির বিপৎসীমা নির্ধারণ করা না থাকলেও প্রতিদিন চারবার ও সন্ধ্যার পর একবার মিলিয়ে মোট পাঁচবার পানির পরিমাপ করা হয়।

লোভাছড়া এলাকায় বসবাস করেন নিরঞ্জন। পরিবারে তাঁর স্ত্রী ও এক সন্তান রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে এ পদে আছেন নিরঞ্জন। তিনি জানান, এবারই প্রথম ঈদের দিন সতর্কতার সঙ্গে পানি পরিমাপ করতে হয়েছে। নিরঞ্জন বলেন, ‘নদী শান্ত থাকলে আমরার মনটাও শান্তিত থাকে।’

কুশিয়ারা নদীর শেরপুর স্টেশনে পানি পরিমাপক জাহাঙ্গীর বখতকে সন্ধ্যার সময় ফোন দিলে তিনি জানান, দিনের শেষ বেলার পানি পরিমাপ করে ফিরেছেন মাত্র। ঈদ কেমন কাটল? জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর কথা বলার মধ্যে খানিকটা নীরব বলে মনে হয়। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, ‘আমারারে তো এইভাবে কেউ কোনো সময় জানতে চায় না। স্যার কইন আর সাংবাদিক কইন—ফোন কল কইরাই শুধু পানির খবর নেইন। এর বাইরে কোনো মাতকথা অয় না। আমরাও ভালা-মন্দ কিছু না বলে পানির হিসাবই দিই।’

জাহাঙ্গীর বখত ২০০৬ সাল থেকে এ পদে আছেন। বাড়ি কুশিয়ারা তীরের শেরপুর এলাকার সাদীপুর গ্রামে। মা, স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর পরিবার। জাহাঙ্গীর জানান, তাঁর পয়েন্টটি কুশিয়ারা নদীর মধ্যবর্তী একটি অংশ। এ জন্য শেরপুর পয়েন্টের পানি বাড়া আর কমার মধ্যে পুরো নদীর পর্যবেক্ষণ নির্ভর করে। গত মে মাস থেকে পাহাড়ি ঢল নামলেও মধ্য জুন থেকে কুশিয়ারার পানি বাড়তে থাকে। ৩০ জুন থেকে প্রথম দফা ও ১৬ জুলাই দ্বিতীয় দফা কুশিয়ারার শেরপুর পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত প্রায় এক সপ্তাহ পানি বিপৎসীমার নিচে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।

মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে জাহাঙ্গীর ছুটছিলেন আজ (শনিবার) দিন শেষে রাতের সর্বশেষ পানি পরিমাপ করার কাজে। শেরপুর পয়েন্টের কাছে পৌঁছে তিনি ঈদ কেমন কাটল, কথার জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘পানির খবর ছাড়া আমরারে তো কেউ কোনতা জিগায় না। জানতা চাইছিলা ঈদ কেমনে কাটল। ছুটি নাই ঠিক আছে। কিন্তু বেতনটা একেবারে কম। মাস শেষে আমরা বেতন পাই মাত্র ৭ হাজার টাকা। এই টাকা মাস্টাররোলের কর্মচারীর বেতনেরও কম। ঈদ কেমন কাটল এই বার বুঝুইন।’