নাগরিক সেবা ব্যাহত, উন্নয়নে বরাদ্দ কম দিনাজপুর পৌরসভায়

জরাজীর্ণ দিনাজপুর পৌর ভবন। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা
ছবি: প্রথম আলো

পৌর শহরের অধিকাংশ রাস্তায় বড় বড় গর্ত। নর্দমার মধ্যে জমে থাকছে ময়লা পানি। অতিবৃষ্টিতে পানি উপচে পড়ছে রাস্তায়। ভাঙাচোরা নর্দমায় ঢাকনাও নেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বর্জ্যের স্তূপ। কিছু কিছু রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতি না থাকায় সন্ধ্যার পরই নেমে আসে অন্ধকার। উন্মুক্ত ময়লা গাড্ডা থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। অনিয়ন্ত্রিত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক আর শহরের মধ্যে দিয়ে দূরপাল্লার বাসের কাউন্টারে তীব্র যানজট। সংস্কার নেই পৌরভবনসহ পৌরসভা-নিয়ন্ত্রিত হাটবাজার, বাস ও ট্রাক টার্মিনালে।

এ অবস্থা দিনাজপুর পৌর এলাকার। গত ১০ বছরে দিনাজপুর সদর উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কারকাজ চোখে পড়লেও উন্নয়নের ছোঁয়া পায়নি পৌর এলাকার বাসিন্দারা। টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর পৌর মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক পদে আছেন।

১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুর পৌরসভা। ১৯৯০ সালে প্রথম শ্রেণির পৌরসভার মর্যাদা লাভ করে। বর্তমানে ২৬.৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে পৌর এলাকা। ১২টি ওয়ার্ডে ৩ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। পৌরসভার হিসাব অনুযায়ী (জুন-২০২০) বর্তমানে হোল্ডিং সংখ্যা ২৯ হাজার ২৬৭টি। নিয়মিত কর্মচারী ৭৩ জন, অনিয়মিত ২৬৯ এবং ঝাড়ুদার ১০৪ জন।

সংস্কার নেই রাস্তাঘাট, টার্মিনাল, হাটবাজারের

পৌর এলাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ ১৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১২২ কিলোমিটার পাকা আর কাঁচা রাস্তা ৪৪ কিলোমিটার। ৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার কংক্রিটের (আরসিসি) এবং ৬ কিলোমিটার ইট বিছানো।

পৌর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শহরের এক-তৃতীয়াংশ রাস্তায় পিচ উঠে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তার ওপর দিয়েই চলছে মোটরবাইকসহ ভারী যানবাহন। বর্ষায় কাঁদা আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালির মধ্যে দুর্ভোগে পৌরবাসী। বিশেষত লিলির মোড় থেকে বালুয়াডাঙ্গা শহীদ মিনার (এক বছর পূর্বে কাজ করা হয়েছে), ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, চারু বাবুর মোড় থেকে বাহাদুর বাজার, রামনগর এলাকা, চারুবাবুর মোড় থেকে ক্ষেত্রীপাড়া, কোতোয়ালি থানার পেছন থেকে মালদহপট্টি হয়ে নিমতলা মোড়, ঘাসিপাড়া হয়ে চাউলিয়াপট্টি, ষষ্ঠীতলা থেকে বড় ময়দান এলাকার রাস্তাঘাট যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

চাউলিয়াপট্টি এলাকায় ইজিবাইকচালক এরশাদুল হক (৩৬) বলেন, রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা হওয়ার কারণে গাড়ির ব্যাটারি ধাক্কা পায় বেশি। ব্যাটারির পানি পড়ে যায়। এক জোড়া ব্যাটারির দাম ২৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে যাত্রীদের অভিযোগ, রামনগর এলাকা আর শেখপুরা এলাকার রাস্তা এতই খারাপ যে অটো পর্যন্ত যেতে চায় না।

দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় পৌরসভা নিয়ন্ত্রিত বাস টার্মিনালটির অবস্থাও বেহাল। টার্মিনাল এলাকাজুড়ে বড় বড় খানাখন্দ। বর্ষায় জমে থাকছে পানি। আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলা। টার্মিনালের পশ্চিমে ময়লার স্তূপ। যাত্রীদের ওয়েটিং রুমে নেই বসার ব্যবস্থা। বৈদ্যুতিক বাল্ব না থাকায় টার্মিনালের ভেতরের অংশ পুরো অন্ধকার। নোনা ধরা স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে পানের পিক।

টার্মিনাল এলাকায় পঞ্চগড়গামী তৃপ্তি এন্টারপ্রাইজ গাড়ির টিকিট কিনেছেন রাজেন্দ্রনাথ রায়। একটু পরেই বাস ছাড়বে। রাজেন্দ্র বলেন, যদিও টার্মিনালে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। আধঘণ্টা পরপরই বাস পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে কাদাপানি আর দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল। একটিমাত্র টয়লেট, সেটিও ব্যবহারের অনুপযোগী।

দিনাজপুর বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি ভবানী আগরওয়াল বলেন, টার্মিনালটির সংস্কারের বিষয়ে পৌর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু সংস্কার হয়নি।

পৌরসভার নিয়ন্ত্রণাধীন হাটবাজার রয়েছে ৪টি। এগুলো হলো রেলবাজার, চকবাজার, বাহাদুর বাজার এবং রামনগর বাজার। এই বাজারগুলোর সংস্কার না হওয়ায় বৃষ্টি বাদলের দিনে ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। বর্ষায় বাজারের রাস্তা হয় কর্দমাক্ত। বিশেষত রেলবাজার পশুহাটে লেগে থাকে পানি।

ময়লা আবর্জনার স্তুপে বন্ধ হয়েছে খালের পানি প্রবাহ। দিনাজপুর পৌর শহরের ঘাষিপাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভঙ্গুর, শহরে ময়লার স্তূপ

পৌরসভার হিসাবমতে, পৌর এলাকায় নর্দমা আছে ৫৫ হাজার ৯৮৭ মিটার। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় প্রতিটি ওয়ার্ডের নর্দমাগুলো ভেঙে গেছে। ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি হয়ে আছে। নর্দমা দিয়ে পানি প্রবাহ না হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই পানি উপচে পড়ছে রাস্তায়। তার ওপর দিয়েই চলাচল করছে মানুষ। শহরের কালীতলা, বালুয়াডাঙ্গা, পুলহাট বিসিক, সুইহারি এলাকায় প্রায় সারা বছরই রাস্তায় জমে থাকে ময়লাপানি।

পৌর এলাকায় ডাস্টবিন রয়েছে ১১৫টি, যার মধ্যে ১৬টি ডিপো। যেখানে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা প্রতিদিন শহরের ময়লা জমা করে। রয়েছে ৯৮টি আবাসিক ডাস্টবিন, যেখানে বাসিন্দারা বাড়ির ময়লা জমা রাখে। আর শহরের মাতাসাগর এবং চক কাঞ্চন এলাকায় রয়েছে দুটি ময়লার গাড্ডা। যেখানে ডিপো ও আবাসিক ডাস্টবিনের ময়লা স্থায়ীভাবে জমা রাখা হয়। তবে স্থানীয় লোকজনে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক মাস চক কাঞ্চন এলাকার ময়লার গাড্ডায় ময়লা ফেলানো বন্ধ রয়েছে। পর্যাপ্ত ডাস্টবিন না থাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ময়লা ফেলছেন অনেকেই। আবার আবাসিক ডাস্টবিনগুলোর প্রায় সবকটিই ভাঙা ও উন্মুক্ত। ৪ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো ডাস্টবিনই নেই। এর ফলে নর্দমার মধ্যেই গৃহস্থালির ময়লা ফেলার কারণে নর্দমার পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

পৌরসভার পয়ঃপ্রণালি শাখার পরিদর্শক মো. নাঈম হোসেন বলেন, এই পৌরসভায় সুষ্ঠু ময়লা ব্যবস্থাপনার জন্য সর্বনিম্ন ৩৫০টি ডাস্টবিন প্রয়োজন। সেখানে ডাস্টবিন আছে মাত্র ১১৫টি। তাই মানুষ উপায়ান্তর না দেখে যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে। ময়লা পরিবহনের জন্য গাড়ির চাহিদা ১০টি, আছে ৬টি। তাও আবার বড় গাড়িটা দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। ভ্যান আছে মাত্র ৮টি।

সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার

পৌর এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি রয়েছে ৮ হাজার ১২০টি। হাই ভোল্টেজ পোল রয়েছে ১ হাজার ৫২০টি। পৌরসভার হিসাবমতে, ৮৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ পৌর এলাকায় বৈদ্যুতিক সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। শহর ঘুরে দেখা যায়, কিছু খুঁটিতে বৈদ্যুতিক বাতি নষ্ট। খুঁটিতে বাতি থাকলেও অধিকাংশ বাতিতে নেই সেপটিক ঢাকনা। তাই অতিবৃষ্টি কিংবা ঝড়ের আঘাতে নষ্ট হয়ে যায়। শেখপুরা এলাকার সিটি কলেজ এলাকা, চাতরাপাড়া, এলজিইডি মোড়, ষষ্ঠীতলা থেকে চাউলিয়াপট্টি অটোস্ট্যান্ড, সুইহারির পর থেকে কলেজ মোড় এলাকায় অধিকাংশ খুঁটিতে বৈদ্যুতিক বাতি নষ্ট হওয়ায় সন্ধ্যার পর থাকে অন্ধকার। শহরের প্রধানতম সড়ক কলেজ মোড় থেকে বাহাদুর বাজার পর্যন্ত যতক্ষণ দোকানপাট খোলা থাকে, ততক্ষণ আলো থাকে। দোকানপাট বন্ধ হলে দেখা যায় ৩ কিলোমিটার জায়গায় ১৩ বাতি জ্বলে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিজ উদ্যোগে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার তাঁর এলাকায় প্রতিটি পোলের মধ্যে এনার্জি বাল্ব লাগিয়েছেন।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে পৌরসভার কার্যক্রম

দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মো. আজিজার রহমান কর দিতে এসেছিলেন পৌরসভায়। টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলে পৌরসভার সচিবের টয়লেট ব্যবহার করেন তিনি। টয়লেট থেকে বের হয়ে সচিবকে বলেন, ‘সারা দেশের মধ্যে একমাত্র দুর্বল এবং নোংরা পৌরসভার নাম দিনাজপুর পৌরসভা।’ তাঁর কথা শুনে টয়লেটের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ফ্লোরে পানি জমে আছে। দরজায় ছিটকিনি নেই। টয়লেটের ফ্ল্যাশ নষ্ট। সেই সঙ্গে দুর্গন্ধ।

শুধু টয়লেটই নয়, ১৯০৩ সালে নির্মিত একটি একতলা এবং একটি দ্বিতল ভবনে চলছে পৌরসভার কার্যক্রম। দুটি ভবনেরই প্রতিটি কক্ষের ছাদ ও করিডর থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। বেরিয়ে আছে মরচে পড়া রড। দেয়াল ও সিঁড়িতে বড় বড় ফাটল। দরজা-জানালা ভাঙা। পর্যাপ্ত আলো নেই। এরই মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করছেন। মূল ভবনের ছাদ গড়িয়ে পড়ছে পানি। এক কর্মকর্তা জানান, গেল বর্ষায় বেশ কিছু কাগজপত্র বৃষ্টিতে ভিজে নষ্টও হয়ে গেছে।

কর দিয়ে সেবা মেলে না

পৌরসভার কর আদায়কারী রয়েছেন ১৯ জন। কর আদায় করতে পৌরবাসীর অকথ্য গালিগালাজ শুনছেন তাঁরা। রোববার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ২৫টি বাড়িতে কর আদায়ের কাজ করেছেন আদায়কারী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। দিন শেষে আদায় করতে পেরেছেন সাড়ে চার হাজার টাকা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কর আদায় করতে গিয়ে মানুষের নানান কথা শুনতে হয়। অনেকে বলেন, ‘সেবা দেওয়ার নাম নাই খালি টাকা নেওয়ার ধান্দা। যা তোর মেয়রক নিয়া আয় তারপর কর দিমু।’

ভাঙাচোরা রস্তায় ধুলোবালির মধ্য দিয়েই চলছে মানুষ ও যানবাহন। সম্প্রতি শহরের ষষ্ঠীতলা রেলঘুন্টি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বাসাবাড়ি কিংবা সরকারি অফিস—প্রায় সবার অভিযোগ, কর দিই সেবা পাই না। পৌরসভার সেবার মান নিয়ে কথা তুলতেই নিমনগর এলাকায় সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল বিশ্বাস কর প্রদানের রসিদ বের করেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘গত ১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৬ হাজার টাকা এবং ১৯-২০ অর্থবছরে ৪৯ হাজার টাকা কর পরিশোধ করেছি। অথচ গত বর্ষায় হাঁটুপানি ডিঙিয়ে অফিসে প্রবেশ করতে হয়েছে। কলেজের সামনে প্রায় সময়ই জমে থাকছে ময়লাপানি। একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান, অথচ পুরো রাস্তায়ই অন্ধকার থাকে। একাধিকবার অভিযোগ করেও সুফল পাইনি।’

দিনাজপুর একাডেমি স্কুলের শিক্ষক মুস্তারিরা বেগম বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি পৌরসভার লোকজন এসে বাড়ির আশপাশের রাস্তায় মশার ওষুধ স্প্রে করে, রাস্তায় ধুলা হলে পানি ছিটিয়ে যায়, কিন্তু এখন সেই কাজগুলো করতে দেখা যায় না। বাড়ির সামনে উন্মুক্ত ড্রেন। কতবার বলেছি ড্রেনের ঢাকনার বিষয়ে। কর্ণপাতই করে না কেউ। নিয়মিত কর পরিশোধ করছি। এতটুকু নাগরিক সেবা পাব না, এটা হয় না।’

চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ ও আয় দুটোই কম

গত পাঁচ বছরে দিনাজপুর পৌরসভা এডিবির উন্নয়ন বরাদ্দ পেয়েছে ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট তহবিল থেকে ঋণ পেয়েছে ৫ কোটি ৮৮ লাখ ৭৩ হাজার ৪১৭ টাকা। মশক নিধন, ডেঙ্গু ও কোভিড-১৯ বিষয়ে বরাদ্দ পেয়েছে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ নগর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ পেয়েছে ৭ কোটি ২ লাখ টাকা।

বরাদ্দকৃত অর্থে গত ৫ পাঁচ বছরে উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৫ দশমিক ১৯২ কিলোমিটার রাস্তায় বিটুমিনাস কার্পেটিং করা হয়েছে। ব্রিক সিসি রাস্তা হয়েছে ৮ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার, আরসিসি রাস্তা ১ দশমিক ৫৭৩ কিলোমিটার, এসবিসি রাস্তা ৬ কিলোমিটার। অন্যদিকে ড্রেন (ইট) নির্মাণ হয়েছে ৪৪.৪৩ কিলোমিটার, আরসিসি ড্রেন (কংক্রিট) ১৯ দশমিক ২৬১ কিলোমিটার। ড্রেনে স্লাব স্থাপন হয়েছে ২ দশমিক ৩০৬ কিলোমিটার। এ ছাড়াও হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন হয়েছে ১৫টি, রাস্তা আলোকিতকরণে ৩ সহস্রাধিক বৈদ্যুতিক বাল্ব (এনার্জি) ও শেড স্থাপন করা হয়েছে।

গত ৫ বছরে পৌরসভা হোল্ডিং ট্যাক্স, ইমারত নির্মাণ, ট্রেড লাইসেন্স, হাটবাজার ইজারা প্রদান, পানি সেবা থেকে আয় করেছে প্রায় ৩৭ কোটি ৩ লাখ টাকা, যার বিপরীতে গত ৫ বছরে পৌরসভায় তার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা, মেয়র-কাউন্সিলরদের সম্মানী ভাতা, সংস্থাপন ব্যয়সহ (জ্বালানি, স্টেশনারি, আসবাব ক্রয়, টেলিফোন বিল, বিদ্যুৎ বিল), পৌরসভা কর্তৃক পরিচালিত মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল পরিচালনায় ভর্তুকি বাবদ ব্যয় করেছে ৩৮ কোটি ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

পৌরসভার কাঁধে দেনার দায়

উন্নয়ন বরাদ্দ ও আয় দুটোই কম। সেই সঙ্গে বাড়ছে পৌরসভার দেনা। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) দুটি ইউনিট থেকে পৌরসভার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে ১৫ কোটি ২০ লাখ ৪৫ হাজার ৯৯৯ টাকা। যদিও পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, নেসকোর অফিস পৌরসভার জমিতে অবস্থিত। সেই জমির ভাড়া বাবদ তিনি যে টাকা পাবেন, তাতে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ হয়ে বরং পৌরসভার কাছে উল্টো নেসকোই দেনায় থাকবে। অবশ্য নেসকো-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করাসহ মেয়রের উত্থাপিত জমি দাবির বিষয়ে আলোচনায় বসার জন্য একাধিকবার পত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না হওয়াসহ বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে আরবান গভর্ন্যান্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্প-২ (ইউজিআইআইপি)-এর বরাদ্দকৃত ২৫ কোটি টাকা ফেরত চলে যায়।

বিদ্যুৎ বিল ছাড়াও বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের কাছে ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা এবং পৌরসভার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা দেনা রয়েছে পৌরসভার।

মেয়র-কাউন্সিলদের সমন্বয়হীনতায় ব্যাহত উন্নয়ন

পৌরসভায় সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্যসহ ১৬ জন কাউন্সিলর। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর ছিলেন ১২ জন। বাকিরা বিএনপি-সমর্থিত। প্রায় সময়ই মেয়র ও কাউন্সিলদের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে লেগে থাকে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও কাজে সমন্বয়হীনতা। গত বছরের আগস্ট মাসে ৯ জন কাউন্সিলর মেয়রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। সে সময় সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিলররা মেয়রের অযোগ্যতা, উদাসীনতাসহ আর্থিক অনিয়মেরও অভিযোগ এনেছিলেন। যদিও তার পরের দিনই কাউন্সিলরদের অভিযোগের জবাব দিতে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন মেয়র। সেখানে মেয়র বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে দুদক পর্যন্ত অনুসন্ধান করেছে। অনিয়ম না পাওয়ায় তাঁকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে।

পৌরসভার উন্নয়ন কার্যক্রম ও সেবার নিম্নমানের বিষয়ে জানতে চাইলে পৌর মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দিনাজপুর পৌরসভা অনেক বড় একটি পৌরসভা। সেই তুলনায় উন্নয়ন বরাদ্দ অপ্রতুল। রাজনৈতিক বিবেচনায় বরাদ্দ কম পেয়েছি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নগর উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ৭ কোটি টাকার কাজ চলমান। বিশ্বব্যাংক থেকে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ৫০ কোটি টাকা এবং এমজিএসপি প্রকল্পের আওতায় খুব শিগগির ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যাবে।’