নানা বাধা পেরিয়ে নাজমা এখন সফল উদ্যোক্তা

নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন নাজমা আক্তার। রোববার কুমিল্লা নগরের নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকায়
ছবি: এম সাদেক

বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা কামরুল হাসান চেয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী নাজমা আক্তার পারিবারিক কাজে সময় দেবেন। আর দশজন গৃহবধূর মতো সংসার আগলে রাখবেন। কিন্তু নাজমা আক্তারের জীবনের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন মানুষকে সহায়তা করবেন। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। স্বপ্ন পূরণ করার জন্য ভর্তি হন সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্রে। প্রশিক্ষণ শেষে একটি সেলাই মেশিন কেনেন। সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে হাঁটি হাঁটি পা পা করে নাজমার পথচলা শুরু হয়। এর মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে।

এখন এই অধ্যবসায়ী উদ্যোক্তা নাজমা আক্তারের নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। কুমিল্লা নগরের নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকার ‘রিমি টেইলারিং শপ’ নামের ওই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আছে ২০টি সেলাই মেশিন। এতে কাজ করেন ২৫ জন কর্মী। তাঁদের মধ্যে ১০ জন পুরুষ। নানা ধরনের বাধা পেরিয়ে নাজমা এখন উদ্যোক্তা। ভালো কাজ করার জন্য তিনি জাতীয় যুব উন্নয়ন পদক, জয়িতা সম্মাননা ও আত্মকর্মী নারী পুরস্কারও পেয়েছেন।

নাজমা আক্তারের বাবার বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার মৌকরা গ্রামে। ১৯৯৩ সালে এসএসসি পাস করার পর গ্রামীণ ব্যাংকের নাঙ্গলকোট শাখার সহকারী কর্মকর্তা কামরুল হাসানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এরপর তিনি স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি পটুয়াখালী চলে যান। সেখানেই তিনি কাজ শুরু করেন। এখন তিনি আবার কুমিল্লায় ফিরে এসেছেন।

উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শোনা যাক নাজমা আক্তারের মুখেই, ‘বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি পটুয়াখালীতে চলে যাই। সেখানে আমার প্রথম কন্যাসন্তান হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে মামাশ্বশুর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের একটি সেলাই কোর্সে ভর্তি করে দেন। ১৯৯৭ সালে আমি একটি মেশিন দিয়ে সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। আমার সেলাইয়ের কাজ দেখে স্বামী বিরক্ত হয়ে মেশিনের গোল চাকা খুলে আলমারিতে রেখে যেতেন। তখন আমার সেলাইয়ের কাজ বন্ধ হয়ে যেত। এরপর লুকিয়ে লুকিয়ে স্বামীর অগোচরে কাজ করি। এই সময় আমার কাজের মান পটুয়াখালী শহরে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর আমাকে জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে।’

নারী উদ্যোক্তা নাজমা আক্তার
ছবি: প্রথম আলো

নাজমা আক্তার বলেন,‘২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয় পুরস্কার নিই। এতে করে আমার কাজের গতি বেড়ে যায়। একপর্যায়ে আমি সিদ্ধান্ত নিই কুমিল্লায় চলে আসার।’

উদ্যোক্তা হওয়ার পথে এসেছে বাধা। সেই বাধার সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে গেছেন নাজমা আক্তার। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কুমিল্লার একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ নেন। আমিও তাঁর সঙ্গে ২০০৬ সালে কুমিল্লায় চলে আসি। এখানে আসার সময় সেলাইয়ের কাজ করে জমানো ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা নিয়ে আসি। ওই টাকার মধ্যে দেড় লাখ টাকা আমার স্বামী একটি বহুমুখী সমবায় সমিতিতে রাখেন। সেই টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি লাপাত্তা হয়ে যায়। অবশিষ্ট ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে কুমিল্লা শহরে সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। কুমিল্লা নগরের অন্তত আটটি ভাড়া বাসায় ছিলাম। কোনো কোনো ভাড়া বাসায় আমাকে সাইনবোর্ড লাগাতে দিত না। অবশেষে থিতু হই নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকার একটি বাসায়। এখন আমার প্রতি মাসে বেতন–ভাতা, কাপড় কেনা বাবদ খরচ হয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকা লাভ থাকে।’

রিমি টেইলারিং শপে একদিন
কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড়-ধর্মপুর সড়কের নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকার চার কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় নাজমা আক্তারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রথম কক্ষে তাকে সাজানো নানা ধরনের কাপড়, নকশিকাঁথা। এক পাশে সেলাই মেশিনে বসে কাজ করছেন নাজমা আক্তার। তাঁর কাছে বসেই কাজ করেন শারীরিক প্রতিবন্ধী (একেবারেই খাটো) কুমিল্লার হাওড়াতলি এলাকার তাহমিনা আক্তার (১৯)। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে আপার কাছে কাজ শিখছি। তিনি আমাকে হাতে–কলমে কাজ শিখিয়েছেন।’
তাহমিনার পাশে বসা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী এলাকার ডিলন পাল (৫৫)। তিনি বলেন, ‘দেড় বছর আগে দুবাই থেকে দেশে আসি। এখন বেকার। দুই ছেলের একজন একাদশ শ্রেণিতে, আরেকজন নবম শ্রেণিতে। এদের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছি। গত এক মাস নাজমা আপার কাছে কাজ শিখছি।’

নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন নাজমা আক্তার। রোববার কুমিল্লা নগরের নজরুল অ্যাভিনিউয়ে
ছবি: এম সাদেক

নাজমা আক্তারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অন্য কক্ষগুলোও সেলাই মেশিন দিয়ে ঠাসা। চতুর্থ কক্ষে কাজ করছেন গিয়াস উদ্দিন (৩৩), ফাতেমা বেগম (২০), ফারুক হোসেন (৫৫), জিহাদ হোসেন (১৯), অলিউল্লাহ (২৫) ও হেলেনা আক্তার (১৯)। তাঁরা বলেন, ‘আপা (নাজমা আক্তার) ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। তাঁর সঙ্গে থেকে আমরা ভাত খেতে পারছি। পরিবার নিয়ে ভালো আছি।’
রিমি টেইলারিং শপে কথা হয় কুমিল্লা জেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী উপপরিচালক সেলিনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নাজমা স্বপ্নচারী ও পরিশ্রমী নারী। বাধা পেরিয়ে এতটুকু পথ এসেছেন। তাঁকে আমরা প্রণোদনা দিয়েছি। নাজমার ওখানে ২৫ জন কাজ করেন। নারীদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পুরুষদেরও কাজ দিচ্ছেন তিনি।’
নাজমার স্বামী কামরুল হাসান বলেন, ‘নাজমার অদম্য সাহস, পরিশ্রম ও ত্যাগের কারণে রিমি টেইলারিং শপ কুমিল্লা নগরে পরিচিতি পেয়েছে। এখন আমি ওর কাজে সহযোগিতা করছি।’
নাজমা আক্তার আরও বলেন, ‘কুমিল্লায় এসে প্রথমে আমি স্কুলের বাচ্চাদের ড্রেস বানানোর দিকে মনোযোগী হই। মেয়ে রিমির স্কুলের অভিভাবকদের (মা) সঙ্গে আমার খাতির হয়। এরপর আমি কুমিল্লা নগরের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁরা আমাকে সহযোগিতা করেন।’
কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোকসানা মজুমদার বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের পোশাকও নাজমা তৈরি করেন। ওর সেলাইয়ের মান ভালো। নাজমা আত্মপ্রত্যয়ী এক সফল নারী।’