নাব্যতা–সংকটে স্থবির বাঘাবাড়ী নৌবন্দর

নাব্যতাসংকটের কারণে সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারেনি জাহাজ। দৌলতদিয়ায় নোঙর করার পর ছোট নৌযানে করে আনা হয়েছে সার। সম্প্রতি বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে
ছবি: প্রথম আলো

শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা-সংকটের কারণে স্থবির হতে বসেছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী নৌবন্দর। স্বাভাবিক অবস্থায় এ বন্দরে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫টি পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়লেও সপ্তাহ দুয়েক হলো এখানে দুই থেকে তিনটি করে জাহাজ ভিড়ছে। এ অবস্থায় বন্দরের অধিকাংশ শ্রমিকই বেকার হয়ে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

নৌবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বাঘাবাড়ী নৌবন্দরটি উত্তরাঞ্চলের প্রধান নৌবন্দর। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার বেশির ভাগ সারই এ বন্দরের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া সিমেন্টের ক্লিংকার, কয়লা, পাথরসহ আরও বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এ বন্দরে এসে জাহাজ ভেড়ে। প্রতিবছর এই সময়ে সারসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজের ভিড়ে এ নৌবন্দর সরগরম থাকলেও এবার জাহাজ আসা কমে যাওয়ায় বন্দর এলাকা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে রয়েছে।

বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার পর থেকেই বন্দরে অচলাবস্থা শুরু হয়। একপর্যায়ে নৌবন্দরে কর্মরত ৮০০ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় সবাই বেকার হয়ে পড়েন। পরে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হলেও শ্রমিকদের বড় একটি অংশ বেকারই থেকে যায়। তাঁরা ভেবেছিলেন, বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে নৌবন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো স্থবির হতে বসেছে।

বন্দরে কর্মরত ব্যক্তিরা জানান, বছরের এই সময়েই সবচেয়ে বেশি জাহাজ নৌবন্দরে ভেড়ার কথা। অথচ নাব্যতা কমে যাওয়ায় প্রতিদিন দুই থেকে তিনটির বেশি জাহাজ ভিড়তে পারছে না। যে জাহাজগুলো ভিড়ছে, সেগুলোকে ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার আগে প্রায় অর্ধেক পণ্য ছোট নৌযানে খালাস করে ভিড়তে হচ্ছে। এতে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ঠিকাদারেরা পণ্য পরিবহনে নগরবাড়ী ঘাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌঘাট বেছে নিচ্ছেন। ফলে ঐতিহ্যবাহী বাঘাবাড়ী নৌবন্দরটিতে জাহাজের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে।

নৌবন্দরে সার নিয়ে আসা এমভি কাশেম-২ জাহাজের মাস্টার জসিম উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম থেকে আট হাজার বস্তা সার নিয়ে আসছিলেন তিনি। নাব্যতা-সংকটের কারণে তিন দিন দৌলতদিয়ায় নোঙর ফেলে অবস্থান করতে হয়েছে তাঁকে। এরপর ছোট নৌযানে চার হাজার বস্তা সার খালাস করে জাহাজের ওজন হালকা করার পর বন্দরে আসতে পেরেছেন।

জাহাজের চালকেরা বলেন, পণ্যবোঝাই জাহাজগুলো আরিচা পর্যন্ত নির্বিঘ্নে আসতে পারছে। কিন্তু এর পরে বেড়া উপজেলার নতিবপুর, ব্যাটারিরচর, নাকালিয়া, পেঁচাকোলা ও মোহনগঞ্জ নামক স্থানে এসে বিপদে পড়ছে। এসব স্থানে যমুনা নদীর গভীরতা ৭ থেকে ৮ ফুটে নেমে এসেছে। অথচ পণ্যবোঝাই জাহাজ চলাচলের জন্য কমপক্ষে ১০ ফুট গভীরতার প্রয়োজন। তাই জাহাজগুলোকে দৌলতদিয়ায় নোঙর ফেলে ট্রলারসহ বিভিন্ন ছোট নৌযানে আংশিক পণ্য খালাস করে তারপর নৌবন্দরে আসতে হচ্ছে। এতে একদিকে পরিবহন ব্যয় যেমন বাড়ছে, তেমনি প্রচুর সময়ও অপচয় হচ্ছে।

আগে এক দিন কাজ করে ৭০০-৮০০ টাকা রোজগার হতো। এখন দিনে ৩০০-৩৫০ টাকার মতো পাওয়া যায়। তারপরও সব দিন কাজ থাকে না।
নজরুল ইসলাম, নৌবন্দরে কর্মরত শ্রমিক

গত মঙ্গলবার দেখা যায়, বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে তিন-চারটি জাহাজ ভিড়ে রয়েছে। এখানে আরও আছে চার-পাঁচটি সারভর্তি ছোট নৌযান। সেগুলো থেকে প্রায় দেড় শ শ্রমিক সার নামাচ্ছিলেন। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে দিনের যেকোনো সময়ে ৫০০ থেকে ৬০০ শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে বলে কর্মরত ব্যক্তিরা জানান।

শ্রমিক তদারকির দায়িত্বে থাকা বন্দর সরদার আবদুল মজিদ বলেন, কম জাহাজ ভেড়ায় নৌবন্দরের ৮০০ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৫০০ শ্রমিকই বেকার। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় অর্ধেক মজুরি পাচ্ছেন। এ অবস্থায় চরম দুরবস্থায় দিন কাটছে শ্রমিকদের।

বন্দরে কর্মরত শ্রমিক নজরুল ইসলাম বলেন, আগে এক দিন কাজ করে ৭০০-৮০০ টাকা রোজগার হতো। এখন দিনে ৩০০-৩৫০ টাকার মতো পাওয়া যায়। তারপরও সব দিন কাজ থাকে না। করোনার এই সময় তাঁর সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

নৌবন্দরের ইজারাদার আবদুস সালাম বলেন, ছোট নৌযানে অর্ধেক পণ্য খালাস করে জাহাজগুলো আসতে হচ্ছে। এ জন্য প্রতি বস্তায় ১৮ টাকা করে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এ অবস্থায় এ বন্দর দিয়ে পণ্য না এনে নগরবাড়ী, খুলনাসহ অন্য এলাকা দিয়ে পণ্য আনতে শুরু করেছেন পরিবহন ঠিকাদারেরা। ফলে বন্দরটি স্থবির হতে বসেছে।

বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক ও বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের পোর্ট অফিসার সাজ্জাদ রহমান বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে ৭ ফুটের বেশি ড্রাফট বা গভীরতা নিয়ে কোনো জাহাজ আসার কথা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ জাহাজই ১০ থেকে ১২ ফুট ড্রাফট নিয়ে বন্দরে আসছে। ফলে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই নৌপথের বাঘাবাড়ী থেকে আরিচা পর্যন্ত অংশে তিনটি ড্রেজারে খননকাজ চলছে বলে জানান তিনি।