নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রিতে সহায়তা করছে একশনএইড

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মধ্যকাতুলী গ্রামের গৃহবধূ মাহমুদা বেগম খেত থেকে সবজি তুলছেন
ছবি: প্রথম আলো

দেশে শহরের পাশাপাশি গ্রামেও নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। গ্রামে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষিকাজসহ নানা রকমের ব্যবসায়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন নারীরা। তবে বিদ্যমান বাজারব্যবস্থা গ্রামীণ জনপদে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গ্রামীণ বাজারব্যবস্থার বাস্তবতা সামনে রেখে একশনএইড বাংলাদেশ মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিওডব্লিও) নামের একটি প্রকল্প চালু করেছে। প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে পটুয়াখালীর গলাচিপা, ফরিদপুরের সদর ও মধুখালী, বগুড়ার গাবতলী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়। বিদ্যমান গ্রামীণ বাজারব্যবস্থায় টেকসই ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য।

ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের শোলাকুন্ড গ্রামের বাসিন্দা লাকী বেগম (৪২)। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, শিমসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করেন লাকী বেগম। তিনি তাঁর উৎপাদিত সবজি ওই গ্রামে একশনএইডের প্রকল্প কর্তৃক স্থাপিত কালেকশন পয়েন্টে জড়ো করেন। ওই গ্রামে লাকী বেগমের মতো তিনটি দলের আরও ৭০ জন নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। তাঁরাও তাঁদের পণ্য নিয়ে আসেন কালেকশন পয়েন্টে।

সেখানে যদি সব পণ্য পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নেন, তাহলে আর পাশের তাম্বুলখানা বাজারে নারীদের জন্য তৈরি বিশেষ শেডে যেতে হয় না। পণ্য অবিক্রীত থাকলেই তা শেডে নিয়ে যান তাঁরা।

এই কালেকশন পয়েন্ট আর বাজারে নারীদের জন্য তৈরি বিশেষ শেড একশনএইড বাংলাদেশের এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটির সহায়তায় তৈরি করা।
গত শুক্রবার দুপুরে কথা হয় লাকী বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথমদিকে বাজারের শেডে গিয়ে সবজি বিক্রিতে সমস্যা হতো। এখন খুব একটা সমস্যা হয় না। স্বামীও তাঁকে এ কাজে সাহায্য করেন।

সরেজমিন তাম্বুলখানা বাজারসংলগ্ন একশনএইডের নারী উদ্যোক্তাদের কৃষিপণ্য বিক্রয়কেন্দ্রে দেখা যায়, সেখানে একসঙ্গে চারজন নারীর স্থায়ীভাবে এবং পাশে নারীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে অন্যান্য নারীর অস্থায়ীভাবে পণ্য বিক্রির সুযোগ আছে।

ফরিদপুরের মনোজা বেগম নিজে সবজির বাগানের পরিচর্যা করছেন
ছবি: প্রথম আলো

তাম্বুলখানার মোনোজা বেগম (৪৮) তাঁর ৭৫ শতাংশ জমিতে সবজি চাষ করেন। তিনি তাম্বুলখানা বাজারে নারীদের জন্য তৈরি শেডে নিয়ে সবজি বিক্রি করেন। তাম্বুলখানা বাজারে প্রতি বৃহস্পতি ও সোমবার হাট বসে। ওই হাটেই নির্দিষ্ট শেডে নারীরা তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে নিয়ে যান। মোনোজা বেগম বলেন, বাজারে প্রতিদিন পণ্য বেচা-কেনার সুযোগ থাকলে ভালো হতো। আগে সামাজিকভাবে তাঁদের উপহাস করা হতো। এখন সে প্রবণতা কমে গেছে।

তাম্বুলখানা বাজার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সহ্জদ্দীন মাতুব্বর জানান, নারীদের বিক্রয়কেন্দ্রটি আরও বড় আকারে করা হলে এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ত। এ ছাড়া প্রতিদিন এ বাজার চালু থাকলে নারী উদ্যোক্তরা আরও বেশি উপকৃত হতেন।

সবজির জমি পরিচর্যা করছেন মনজিলা বেগম
ছবি: প্রথম আলো

রাজেনা বেগম, মধু রানী, কানিজ ফাতেমা, মনজিলা বেগম সবাই গাইবান্ধার সফল নারী উদ্যোক্তা। তাঁদের কেউ সবজি চাষ, কেউ গরু মোটাতাজাকরণ, কেউ মুরগির খামার করছেন। এই নারী উদ্যোক্তাদের বাড়ির কাছেই কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র নির্মাণ করে দিয়েছে একশনএইড বাংলাদেশ। সেখানেই তাঁরা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছেন।

রাজেনা বেগমের (৪৫) বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়নের ধুবনি গ্রামে। তাঁর পরিবারের সম্পদ বলতে বসতভিটাসহ আটবিঘা জমি। এসব জমিতে ধান, পাটের চাষ করতেন। বছর তিনেক আগে তিনি প্রকল্পের কারিগরী সহায়তায় বসতভিটাসহ দুই বিঘা জমিতে সবজি চাষ শুরু করেন। বাড়ির পাশে ধুবনি বাজারের নারীবান্ধব মহিলা মার্কেট কর্নারে তাঁর উৎপাদিত সবজি বিক্রি করেন। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা ট্রাকে করে এখান থেকে সবজি নিয়ে যান।

সবজি ছাড়াও রাজেনা বেগমের দুটি গাভী আছে। গাভী দুটি দৈনিক ১৫ লিটার দুধ দেয়। একই মার্কেটে দুধও বিক্রি করেন তিনি। এ ছাড়া ১৫টি হাঁস, ১৬টি মুরগি ও ২টি ছাগল রয়েছে। বাড়িসংলগ্ন পুকুরে মাছ চাষ করেও তাঁর আয় হচ্ছে। রাজেনার মাসিক মোট আয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা।

এ প্রসঙ্গে এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের সহযোগী সংস্থার সমন্বয়কারী কৃষিবিদ জামাল উদ্দিন বলেন, কৃষকেরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাতকরণ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিখতে পারেন, সে জন্য স্থানীয় প্রশাসন, কৃষি বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ, প্রাণিসম্পদ কার্যালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে কৃষকদের সংযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত মাঠ সহকারী রিনা পারভীন জানান, কৃষক রাজেনা বেগম ও তাঁর স্বামীকে সবজি ও মাছ চাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যাতে তাঁরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবজি ও মাছ চাষ করছেন।

মধূ রানী নিজের খামারে গরুর পরিচর্যা করছেন
ছবি: প্রথম আলো

মধু রানীর (৩০) বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়নের সীচা গ্রামে। কয়েক বছর আগে মধু রানী গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসা শুরু করেন।

জেলার বিভিন্ন হাট থেকে গরু কিনে সেগুলো পালন করেন মধু রানী। চার মাস পালন করার পর ৩০ হাজার টাকার একেকটি গরু ১ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা ট্রাকে করে গরু নিয়ে যান। এখন অনলাইনেও গরু বিক্রি করছেন।

এ ছাড়া মধু রানীর দুটি গাভি আছে। গাভি দুটি দৈনিক ১২ লিটার দুধ দেয়। দুধ বিক্রি করেও মাসে তাঁর ১৮ হাজার টাকা আয় হয়। তিনি বাড়ির পাশে সীচা বাজারের নারীবান্ধব মহিলা মার্কেট কর্নারে এই দুধ বিক্রি করেন। একশনএইড বাংলাদেশের উদ্যোগে এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের মাধ্যমে এই মহিলা মার্কেট শেড নির্মাণ করে দেওয়া হয়।

গাইবান্ধার আরেক নারী উদ্যোক্তা কানিজ ফাতেমার (৩৫) বাড়ি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রামজীবন ইউনিয়নের কাশদহ গ্রামে। ২০১৬ সালের দিকে একশনএইড বাংলাদেশের এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের আওতায় মুরগির খামার শুরু করেন। ৭৫০টি লেয়ার মুরগি দিয়ে শুরু। বর্তমানে তাঁর খামারে ২ হাজার ১৫০টি মুরগি রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০টি মুরগি দৈনিক ডিম দিচ্ছে। প্রতি মাসে খামারে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার খাদ্য লাগছে। প্রতি মাসে আয় প্রায় ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা। খরচ বাদে তাঁর মাসিক আয় ৭২ হাজার টাকা। ডিম বিক্রির জন্য তাঁকে কোথাও যেতে হয় না। একশনএইড বাংলাদেশের সহায়তায় গ্রামেই কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র চালু হয়েছে।

গাইবান্ধার শাহিনুর বেগম পানের বরজ থেকে পান তুলে ঝুড়িতে সাজাচ্ছে বিক্রির জন্য
ছবি: প্রথম আলো

সফল নারী উদ্যোক্তা পানচাষি শাহিনুর বেগমের (৪৮) বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার চিকনিকান্দি ইউনিয়নের পূর্ব মাঝগ্রামে। শাহিনুর বেগম বলেন, তাঁর স্বামীর বাড়ির পাশে ৬০ শতাংশ জমিতে পানের বরজ ছিল। এ থেকে সংসার চলত না। ২০১৬ সালে তাঁদের গ্রামে এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। তিনিও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং সেখান থেকে পান চাষ, পণ্য বাজারজাতকরণসহ আরও অন্যান্য বিষয়ে জেনেছেন। এরপর নিজেই ৩০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে সেখানে পানের বরজ তৈরি করেন। এখন তাঁর দেড় একর জমিতে পানের বরজ।

বাজারজাত করা প্রসঙ্গে শাহিনুর জানান, তাঁদের পণ্য বিক্রির জন্য কালেকশন পয়েন্ট রয়েছে এবং এর মাধ্যমে তিনি সাধারণত পান বিক্রয় করে থাকেন। তবে মাঝেমধ্যে তিনি স্বামীকে দিয়ে বাজারে আড়তেও পান পাঠান।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার রতনদিতালতলী ইউনিয়নের বড় চৌদ্দকানি গ্রামের নারী উদ্যোক্তা মাহিনুর বেগম (৩৫)। সংসারের খরচ চালাতে নিজ উদ্যোগে বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন। এরপর ২০১৫ সালে কিছু লেয়ার মুরগি দিয়ে খামার শুরু করেন। এখান তাঁর খামারে তিন হাজার লেয়ার মুরগি রয়েছে। দৈনিক আড়াই হাজার ডিম উৎপাদন হয় তাঁর খামারে। ডিম বাজারজাতকরণসহ সবকিছু দেখভাল করছেন মাহিনুর।

সবজি চাষ করে পরিবারের দিন বদলে দিয়েছেন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার রতনদিতালতলী ইউনিয়নের পশ্চিম কাচাড়িকান্দা গ্রামের নুরজাহান বেগম (৩৮) । সবজি চাষের পাশাপাশি নিজেই তৈরি করছেন জৈব সার। এ কাজে শুধু নিজের ভাগ্যবদল হয়নি, তাঁর সফলতা দেখে অনেকেই বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

শুরুতে বাড়ির আঙিনা ও আশপাশে সবজি চাষ শুরু করেন নুরজাহান। উৎপাদিত সবজি নিজেই রাস্তার পাশে বসে বিক্রি করতেন নুরজাহান। সবজি বিক্রি করে লাভবান হলেও কিস্তি পরিশোধ করে টাকা খরচ হয়ে যেত তাঁর।

একপর্যায়ে নুরজাহান গ্রামের বকুল মহিলা দলের সদস্য হন। এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর বিষমুক্ত সবজি চাষ শুরু করেন। বেশি সবজি তোলা হলে সেগুলো একশনএইড বাংলাদেশের সহায়তায় স্থাপিত কমিউনিটি পর্যায়ে কালেকশন পয়েন্টে পাঠান বলে জানান নুরজাহান।

বাজারে বসে মাছ বিক্রি করেন শিরিন বেগম
ছবি: প্রথম আলো

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার রতনদিতালতলী ইউনিয়নের মানিকচাঁদ গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী শিরিন বেগম (৩০)। বিয়ের পরদিনই মাছ বিক্রির জন্য রাস্তার পাশে বসে পড়েন শিরিন। তখন থেকেই শুরু হয় শিরিনের মাছ ব্যবসা। এখন শিরিনের মতো নারী ব্যবসায়ীদের জন্য কালাচাঁদ বাজারে একটি শেড নির্মিত হয়েছে। বাজারে নারীদের জন্য পৃথক শৌচাগার ও ব্রেস্ট ফিডিং কক্ষ নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়া বাজারে শিরিন তাঁর ছেলের নামে আড়ত করেছেন। নাম দিয়েছেন আবদুল্লাহ মৎস্য আড়ত।

শিরিন জানান, কষ্ট করতে করতে তিনি বড় হয়েছেন। বিয়ের পরও অনেক কষ্ট করেছেন। রাস্তার পাশে মাছ নিয়ে বসে বিক্রি করার বিষয়টি অনেকেই অন্যভাবে দেখেছে। তবে এখন কেউ সেভাবে দেখে না। বাজারে তাঁদের জন্য আলাদা শেড হয়েছে। তাঁর স্বামী বিভিন্ন বাজার থেকে মাছ কিনে এনে দেন। তিনি বাজারে বসে বিক্রি করেন।

একশনএইড বাংলাদেশের এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. শওকত আকবর ফকির বলেন, প্রকল্পটি গ্রামীণ পর্যায়ে কর্ম এলাকায় বিদ্যমান বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনয়নে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এটাকে আরও গতিশীল করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সম্প্রসারণমূলক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের সিনিয়র অফিসার অ্যাডভোকেসি জাকিরুল ইসলাম পিটার জানান যে বিদ্যমান বাজারব্যবস্থাকে আরও নারীবান্ধব করার জন্য একশনএইড বাংলাদেশের এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্পের পক্ষ থেকে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সরকার যথাযথ নীতিমালা গ্রহণ করলে গ্রামীণ এলাকায় নারীবান্ধব বাজারব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটার পাশাপাশি গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তার উন্নয়ন ঘটবে বলে প্রতিবেদকসহ সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিরা মনে করেন।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রবীর কান্তি বালা, ফরিদপুর; শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা; শংকর দাস, পটুয়াখালী)