নিখোঁজের ৪ বছর পর সন্তান নিয়ে ফিরলেন গৃহবধূ

চার বছর আগে হঠাৎ যেভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন এক গৃহবধূ (২২), চার বছর পর ঠিক একইভাবে হঠাৎ করেই বাড়িতে হাজির হয়েছেন তিনি। তবে এই সময়ের মধ্যে ঘটে গেছে নানা ঘটনা। প্রথমে হত্যার অভিযোগ করেছিলেন তাঁর বাবা, পরে তাঁর মা মানব পাচারের অভিযোগে মামলা করেছিলেন। মামলাটি শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হলেও ঘানি টেনেছেন স্থানীয় এক ভ্যানচালক ও তাঁর পরিবার। অন্যদিকে ওই গৃহবধূ দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, তাঁর কোলে এসেছে ফুটফুটে শিশু।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় এই ঘটনায় এলাকায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে। গত রোববার (৪ অক্টোবর) পাঁচ মাসের এক ছেলেশিশুকে নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়েছেন তিনি। তাঁকে তাঁর দ্বিতীয় স্বামী বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন বলে তিনি জানান। তাঁর বাড়ি উপজেলার উয়ার্শী ইউনিয়নের একটি গ্রামে।

এলাকাবাসী ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে নবম শ্রেণির ছাত্রী থাকা অবস্থায় পার্শ্ববর্তী খৈলসিন্দুর গ্রামের এক সৌদিপ্রবাসীর সঙ্গে ওই তরুণীর বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামী সৌদি চলে যান। এর কিছুদিন পর পারিবারিক বিষয় নিয়ে ঝগড়া হলে গৃহবধূ বাবার বাড়ি চলে যান। তিনি বন্ধু চুলা নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। কিছুদিন পর স্বামী দেশে চলে আসেন। এরপর নিখোঁজের ঘটনাটি ঘটে।

মেয়ে নিখোঁজের পর জলিল মোল্লা ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মির্জাপুর থানায় ওই গৃহবধূর স্বামীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মেয়েকে হত্যার অভিযোগ করেছিলেন। পরদিন ২২ সেপ্টেম্বর গৃহবধূর স্বামী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এতে উল্লেখ করেন, তাঁর স্ত্রী স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। এরপর মেয়ের খোঁজ না পেয়ে ওই গৃহবধূর মা ছাহেরা বেগম ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের মানব পাচার ও প্রতিরোধ দমন অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক খান মনিরুজ্জামান তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ওই গৃহবধূর ছোট বোনকে গৃহবধূর স্বামীর কাছে বিয়ের প্রস্তাবের পর দুই পরিবার মামলার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকে। পাচারের কথা মামলায় উল্লেখ থাকলেও তার সত্যতা মেলেনি।

নিখোঁজের পর থেকে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সময়ে ভুক্তভোগী হয়েছেন একই গ্রামের ভ্যানচালক আকবর আলী (৩৫)। আকবর আলী বন্ধু চুলা নামের প্রতিষ্ঠানটিতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। মদিনাকে পাচারের অভিযোগে তাঁর মা ছাহেরা বেগমের করা মামলায় আকবর আলী ছাড়াও তাঁর স্ত্রী লাকী আক্তার (৩২), মা জাকিয়া বেগম (৭০), তিন সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা পুলিশের ভয়ে দীর্ঘদিন বাড়ি থাকতে পারেননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী ভ্যানচালক আকবর আলীর পরিবার। শুক্রবার মির্জাপুর উপজেলার উয়ার্শী ইউনিয়নে
প্রথম আলো

শুক্রবার সরেজমিন ওই গ্রামে গেলে আকবর আলী জানান, চড়া সুদে টাকা ধার করে ও শ্বশুরবাড়ির জমি বিক্রি করে মামলার খরচ চালিয়েছেন। তিন বছরে মামলায় তাঁর সাড়ে ৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। পুলিশের নির্যাতন সহ্য করেছেন। কী ধরনের নির্যাতন সহ্য করেছেন জানতে চাইলে কিছুক্ষণ নীরব থেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, থানার পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে তিনবার, পিবিআই দুইবার আর সিআইডি একবার তাঁকে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে। এর ফলে তিনি মেঝেতে বসতে পারেন না। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না।

আকবরের মা জাকিয়া বেগম বলেন, ‘স্বামী মরণের পর পোলা মাইয়্যাগো নিয়্যা বাইচা আছি। কার কী ক্ষতি করছি। আমার কইলজা ছেঁড়া ধনডারে এমন কইর‌্যা মারছে। আমরা কতডা দিন পুলিশের ভয়ে বাড়ি থাকা পারি ন্যাই। আমি এর বিচার চাই।’

নিখোঁজের বিষয়ে ওই গৃহবধূ বলেন, নিখোঁজের দিন সকালে তাঁর মুঠোফোনে আকবর আলীর কল আসে। এরপর এক ব্যক্তির সঙ্গে তিনি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বালিয়া বাসস্ট্যান্ডে যান। সেখান থেকে তাঁরা বাসে উঠেন। এরপর কোথায় ছিলেন তা জানেন না। তাঁকে একটি ঘরে আটকে রাখা হতো। মাঝেমধ্যে রাতে বের হতেন। ওই ব্যক্তি মেরে ফেলার হুমকি দেওয়াতে তিনি পালাতে পারেননি। তাঁকে গোপালগঞ্জের মামুন ইসলাম উদ্ধার করেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁদের বিয়ে হয়। তিনি কেন গেলেন, কীভাবে উদ্ধার হলেন জানতে চাইলে তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

মির্জাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গিয়াস উদ্দিন জানান, পিবিআই ও সিআইডি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আকবর আলী মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তিনি সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন মনে করলে ইউনিয়ন পরিষদে বিচার চাইতে পারেন। এখানে পুলিশের কিছুই করার নেই।