নিখোঁজ ২৫০, স্বজনদের অপেক্ষা আর ফুরায় না

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটার বাসিন্দা ফজলুল হক কাওসার মোল্যা (৪০)। ১৯৯৪ সালে তিনি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মা ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরবেন, তাই তিনি সেদিন বিদ্যালয় থেকে আগেভাগেই বাড়ি চলে আসেন। মা বাড়ি এলে একসঙ্গে খাবেন। বাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলেন মায়ের জন্য। তাঁর সেই অপেক্ষা আজও ফুরায়নি। এখনো তিনি অপেক্ষা করেন—হঠাৎ যদি মা এসে হাজির হন!

১৯৯৪ সালের ২০ আগস্ট দুপুরে চাঁদপুর শহরের কাছে ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় এমভি দিনার-১ লঞ্চটি ডুবে যায়। ৩৫০ যাত্রীর সঙ্গে ওই লঞ্চে ছিলেন ফজলুল হকের মা জোহরা বেগম (৫৫)। ফজলুল হকের মতো প্রিয় স্বজনের জন্য আজও অপেক্ষা করে আছেন ওই দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ২৫০ যাত্রীর স্বজনেরা। প্রিয়জন হারানোর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আজও তাঁরা অপেক্ষা করছেন।
ফজলুল হক বলেন, ‘মা হারানোর বেদনা যে কত ভয়ানক, তা কেউ বুঝবে না। সন্তান হিসেবে একটা কষ্ট সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। যখন গ্রামের বাড়ি যাই, তখন মায়ের স্মৃতি খুঁজে ফিরি। আজও মায়ের জন্য অপেক্ষা করছি, এমন যদি হতো একদিন মা বাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছেন।’

ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর চরচান্দা মুন্সিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি হয় রোকেয়া আক্তারের (২৮)। তাঁর বোন বিউটি আক্তারের (২৬) চাকরি হয়েছিল চরবাঘা বকাউল বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি সখিপুর ব্যাপারীকান্দি গ্রামে। পরিবারের সঙ্গে গাজীপুরের টঙ্গীতে থাকতেন। দুই বোন বাবা কামরুল ইসলামের সঙ্গে এমভি দিনার–১ লঞ্চে করে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে আসছিলেন। দিনার লঞ্চের হতভাগ্য ২৫০ যাত্রীর মতো তাঁরাও নিখোঁজ হন।
রোকেয়া ও বিউটির চাচাতো ভাই মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চাচাতো বোনদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি আসার খবর চিঠি দিয়ে আগেই জানিয়েছিলেন চাচা। সে অনুযায়ী মা তাঁদের জন্য রান্নাবান্না করে রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁরা আর আসেনি। অন্য যাত্রীদের মুখে শুনেছেন, তাঁরা দ্বিতীয় তলার একটি কেবিনে ছিলেন। লঞ্চটি উদ্ধার না হওয়ায় তাঁদের দেহ উদ্ধার করতে পারেনি প্রশাসন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমভি দিনার-১ লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট থেকে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার বালারবাজার যাতায়াত করত। ১৯৯৪ সালের ২০ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার সময় সদরঘাট থেকে সাড়ে তিন শ যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি ছেড়ে আসে। মাঝখানে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে তিন শ বস্তা চাল তোলা হয়। ওই চালের বস্তাগুলো লঞ্চের পেছনের দিকে রাখা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে লঞ্চটি চাঁদপুর শহরের কাছে ডাকাতিয়া নদীর মোহনায়

পৌঁছালে প্রচণ্ড ঢেউ ও স্রোতের কবলে পড়ে। তখন চালের বস্তাগুলো একদিকে গিয়ে লঞ্চটি কাত হয়ে নদীতে নিমজ্জিত হয়। ৫০ যাত্রী সাঁতার কেটে বাঁচতে পারেন, আর বাকিরা তলিয়ে যান। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিএ) ও চাঁদপুর-শরীয়তপুরের প্রশাসনের উদ্ধার অভিযানে ৫০ যাত্রীর লাশ উদ্ধার হয়। আর বাকি ২৫০ যাত্রীর সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। দিনার লঞ্চটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ভেদরগঞ্জের কাচিকাটার বাসিন্দা মহসিন উদ্দিন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। ভয়াবহ ওই লঞ্চ দুর্ঘটনায় মা ও ভাগ্নেকে হারান তিনি। ওই লঞ্চ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিন বছর পর মারা যান তাঁর মামা। ওই দিনের স্মৃতি তুলে ধরে আজ বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মহসিন উদ্দিন লিখেছেন, ‘১৯৯৪ সালের ওই ঘটনাটি জীবনের দুঃসহ একটি স্মৃতি হয়ে আছে। স্বজন হারানোর যন্ত্রনা বয়ে বেড়াচ্ছি। এটি আসলে দুর্ঘটনা নয়, একটি হত্যা। কেননা ঝড়-বৃষ্টিবিহীন একটি লঞ্চ প্রায় তীরে গিয়ে অন্য লঞ্চের সাথে প্রতিযোগিতা দিতে গিয়ে প্রচণ্ড স্রোতে পেছনের অংশ ভেঙে ডুবে যায়। পেছনের অংশ ডুবে যাওয়ার কারণ, যাত্রীবাহী লঞ্চে অগণিত চালের বস্তা তোলা হয়েছিল। মুহূর্তে হত্যা করা হলো তিন শতাধিক মানুষকে। কেন যাত্রীবাহী লঞ্চে মালামাল তোলা হয়েছিল? কেন বিচার করা হয়নি দায়ীদের?’

ওই দিনের দুর্ঘটনাকবলিত দিনার লঞ্চে যাত্রী ছিলেন সখিপুর বাজারের দরজি ইউনুছ মালত (৫০)। তিনি ঢাকার নিউমার্কেটে একটি দোকানে কাজ করতেন। ছুটিতে বাড়ি ফিরছিলেন ওই লঞ্চের যাত্রী হয়ে। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লঞ্চের ছাদে দুপুরের নামাজ পড়ছিলাম। হঠাৎ দেখি লঞ্চ কাত হয়ে নিচের দিতে ডুবে যাচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানিতে ভেসে যাই। একটি জেলেনৌকা আমাকে উদ্ধার করেছে। ততক্ষণে আমি চেতনা হরিয়ে ফেলি। আমার মতো যাঁরা ছাদে ছিলেন, তাঁরাই কয়েকজন বাঁচতে পেরেছিলেন।’

বিআইডব্লিউটিএর চাঁদপুর নৌবন্দরের বন্দর কর্মকর্তা কাওসারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীর মোহনাটি একটি ভয়ানক জায়গা। সব সময় ওই স্থানটিতে স্রোত থাকে। দিনার ছাড়াও ওই স্থানে আরও কয়েকটি লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। দিনার দুর্ঘটনার পর কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তার সব শেষ পরিস্থিতি কী, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কারণ, তাঁদের দপ্তরটি চার দফা স্থানান্তরিত করা হয়েছে, একবার নদীতে বিলীন হয়েছে। যার কারণে ওই লঞ্চ দুর্ঘটনার বিভিন্ন নথিও হারিয়ে গেছে।