নিজে স্বাবলম্বী, কাজ পেয়েছেন ৪০০ নারী

উদ্যোক্তা জিয়াউল হক তাঁর কর্মীদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। গতকাল রাজশাহীর পবা উপজেলার দারুশা বাজিতপুর গ্রামে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

রাজশাহীর পবা উপজেলার তরুণী শিরিন শারমিন এখন ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন গুগল ব্যবহারে বেশ দক্ষ। তাঁর কাজ হলো ওয়েবসাইট ঘেঁটে পোশাকের নতুন নতুন নকশা খুঁজে বের করা এবং নারী কর্মীদের তা বুঝিয়ে দেওয়া। এ জন্য তাঁর বেতন মাসে ৬ হাজার টাকা।

শিরিন বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিলেন। সংসার টিকেছিল মাত্র তিন বছর। তারুণ্যের শুরুতেই বড় ধাক্কা সামলে তিনি এখন নিজ ইউনিয়নেই কর্মজীবী নারী। পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মতো ৪০০ জন নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে জিয়াউল হক নামের এক উদ্যোক্তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মাধ্যমে।

সরকার দেশের ইউনিয়ন পরিষদগুলোয় বিভিন্ন সেবা দিতে যে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) গড়ে তুলেছে, সেগুলোরই একটির (পবা উপজেলার হুজুরিপাড়া ইউনিয়ন) উদ্যোক্তা জিয়াউল হক (৩৮)। তাঁর পরিচালনাধীন ইউডিসি থেকে সাধারণ মানুষকে সেবা তো দেওয়া হচ্ছেই, সঙ্গে দেশের ১০২টি ইউনিয়নের ইউডিসি উদ্যোক্তাদের নিয়ে তিনি একটি ‘নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলেছেন। যার কাজ হলো, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রসিদ্ধ হস্তশিল্প, কৃষি ও খাদ্যপণ্য, ফল ইত্যাদি অন্য এলাকায় বিক্রি করা। যেমন রাজশাহী থেকে সিল্কের কাপড়, সবজি, আম, সুগন্ধি চালসহ বিভিন্ন পণ্য বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। আবার টাঙ্গাইলের শাড়ি, সিলেটের মণিপুরি শাড়ি, যশোরের খেজুরের গুড়, নকশিকাঁথা, ফরিদপুরের পাটের পণ্য, ঢাকার রুপার গয়না, বিভিন্ন ধরনের ফল ইত্যাদি রাজশাহী এনে বিক্রি করা হয়।

পুরো কাজটি করেন জিয়াউলের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্কের সদস্যরা। তাঁদের ২৫ জনকে নিয়ে একটি কোম্পানিও গঠন করেছেন জিয়াউল। নাম দিয়েছেন রিয়াল এন্ট্রাপ্রেনিউর কোম্পানি লিমিডেট। শুধু তা–ই নয়, ইউডিসির উদ্যোক্তাদের নিয়ে ‘গ্রামের হাট’ নামে একটি ই-কমার্স সাইটও খুলেছেন জিয়াউল। সেখানে ক্রেতারা বিভিন্ন পণ্যের ফরমাশ পাঠান। দেশের ১৭টি জেলায় গ্রামের হাটের ‘ভার্চ্যুয়াল শপ’ রয়েছে।

রিয়াল এন্ট্রাপ্রেনিউর কোম্পানির জন্যই নারীরা বাড়িতে বসে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। গুগল ঘেঁটে শিরিন শারমিনেরা যে পোশাকের নকশা বের করেন, সে অনুযায়ী তৈরি পণ্য ওই কোম্পানির মাধ্যমেই বিক্রি হয়। জিয়াউলের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ইতিমধ্যে স্বীকৃতিও পেয়েছে। ২০১৮ সালে রাজশাহী বিভাগের মধ্যে সেরা ইউডিসি উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কৃত হন জিয়াউল। পুরস্কারটি দেওয়া হয় রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে।

জিয়াউলের বাড়ি পবা উপজেলার হুজুরিপাড়া ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর তাঁকে সংসারের হাল ধরতে চাকরি নিতে হয়। ২০০৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হ্ওয়ার পর আর চাকরি করা হয়নি। দুর্ঘটনায় হাড় ভেঙে যাওয়ায় একটি পা অন্যটির চেয়ে ৬ সেন্টিমিটার ছোট হয়ে যায়। শারীরিক এই ঘাটতি জিয়াউলের মনের জোরকে কমাতে পারেনি। নিজে কম্পিউটার চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। এরপর এলাকায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলেন।

২০১০ সালে হুজুরিপাড়া ইউনিয়নে তথ্যসেবা কেন্দ্র খোলা হলে জিয়াউল উদ্যোক্তার দায়িত্ব নেন। উল্লেখ্য, সরকার এসব তথ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে বেসরকারি খাত থেকে একজন করে উদ্যোক্তাকে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। তারা নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে মানুষকে সেবা দেয়। যেমন জমির নামজারির আবেদন, পাসপোর্টের আবেদন ইত্যাদি। প্রথম মাসে জিয়াউলের আয় হয় মাত্র ১ হাজার ৬৯৭ টাকা। অল্প আয় দেখে তিনি হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু দমে যাননি।

জিয়াউল প্রথম আলোকে বলেন, শুরুর দিকে তিনি ল্যাপটপ নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতেন। বিনা মূল্যে ল্যাপটপে ভিডিও কলে স্বজনদের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের কথা বলিয়ে দিতেন। এতে তাঁর পরিচিতি তৈরি হয়। ডিজিটাল সেন্টারের সেবা সম্পর্কে জানতে পারে মানুষ।

জিয়াউল হক

২০১৪ সালে জিয়াউল বিভিন্ন ইউনিয়নের ইউডিসি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। সেই নেটওয়ার্ক এখন বেশ বিস্তৃত হয়েছে। পণ্য বিক্রি বাড়ছে। যেমন গেল মৌসুমে জিয়াউল ৩ হাজার ৭০০ মণ আম দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছেন। প্রতিদিন রাজশাহী থেকে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নেত্রকোনায় সবজি পাঠানো হয়। সম্প্রতি নিজস্ব পণ্য পরিবহনের জন্য ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ট্রাকও কিনেছে জিয়াউলদের কোম্পানি।

নেটওয়ার্কটি গড়ে তুলতে জিয়াউলের সঙ্গে ছিলেন যশোর সদর ইউনিয়নের উদ্যোক্তা এস এম আরিফুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘জিয়াউলকে আমরা ডিজিটাল সেন্টারের ‘মাশরাফি’ বলি, যিনি কখনো হতোদ্যম হন না। আমরা তাঁকে সামনে রেখে নিজস্ব একটা কুরিয়ার সার্ভিস গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছি।’

হুজুরিপাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে গত ১৩ আগস্ট দেখা যায়, সেবাগ্রহীতারা কেউ পাসপোর্ট তৈরির ফি জমা দিতে এসেছেন। কেউ চান অনলাইনে জমির নামজারির আবেদন করতে। একপাশে বসে মুঠোফোনে কাজ করছিলেন জিয়াউল। সেন্টারে পাঁচজন কর্মচারীও রয়েছেন।

আলাপকালে জিয়াউল বলেন, ওই দিন (১৩ আগস্ট) সিলেটে আলু বিক্রি হচ্ছিল ৪৫ টাকা কেজিতে। রাজশাহীতে একই আলুর কেজি ছিল ৩০ টাকা। তিনি তিন হাজার কেজি আলু সিলেটে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, তাঁরা সামান্য সার্ভিস চার্জ (সেবা মাশুল) নিয়ে পণ্য পাঠানোর কাজটি করেন। এতে উৎপাদনকারী ও ক্রেতা সুফল পায়। কাউকে ঠকতে হয় না।

হুজুরিপাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের আয় মাসে মৌসুমভেদে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। সেখান থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা থাকে জিয়াউলের। দুই শিশুসন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসার বেশ ভালোভাবে চলে যাচ্ছে।

নারীর কাজ

হুজুরিপাড়া ইউনিয়নের প্রশিক্ষণকক্ষে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় ২৫ জন নারীকে নতুন নকশা বুঝিয়ে দিচ্ছেন শিরিন। তাঁদের একজন তাহেরা বেগম। বাড়ি একই ইউনিয়নের বাকশইল গ্রামে। তাহেরা প্রথম আলোকে জানান, তাঁর সংসারে অভাব লেগেই থাকত। গরু-ছাগল চরিয়ে কোনোরকমে চলতেন। এখন সেলাইয়ের কাজ। তাঁর অধীনে প্রায় ১৫০ জন নারী রয়েছেন। তাঁরাও সেলাইয়ের কাজ করেন। তাহেরা আরও বলেন, এখন বেশ ভালো আছেন। ইতিমধ্যে ১৯ কাঠা জমিও কিনেছেন।

পবা উপজেলার বাজিতপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একদল নারী বাঁশঝাড়ের ছায়ায় বসে সেলাইয়ের কাজ করছেন। তাঁদের উদ্যোক্তা আরজিনা বেগম (২৫) বলেন, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সকালে কাজে যাওয়ার পর তাঁরা একসঙ্গে এক জায়গায় বসে সেলাই করেন। কারও ভুল হলে আরেকজন শিখিয়ে দেন। গল্পে গল্পে কাজ এগিয়ে যায়। তাঁরা একেকজন মাসে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করেন।

জিয়াউলের কাজে সহায়তা করেন হুজুরিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, জিয়াউল বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। বিশেষ করে আম পাঠিয়ে। এখন মানুষ বিশ্বাস করে তাঁর কাছে পণ্য কিনতে টাকা পাঠায়।

আরও উদ্যোগ

বাজিতপুর গ্রামে জিয়াউল গরুর খামারও করেছেন। এর দায়িত্বে রয়েছেন রুবাইয়া খাতুন (৩০) নামের এক নারী। পরিচর্যাকারী হিসেবে রুবাইয়াকে একটি ঘর করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর পারিশ্রমিক দৈনিক ২০০ টাকা। এ টাকা প্রতিদিন রুবাইয়ার সঞ্চয়ী হিসাবে রিয়াল এন্ট্রাপ্রেনিউরের পক্ষ থেকে জমা হয়। রুবাইয়ার জমানো টাকা দিয়ে তাঁকেই একটি গরু কিনে দেওয়া হবে। তিনিই হবে খামারি।

হুজুরিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই জিয়াউলের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগীতচর্চা কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে সংগীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষক রয়েছেন। নিয়মিত শিক্ষার্থী ১৭ জন। সন্ধ্যার পর স্থানীয় শিল্পীরা আসর বসিয়ে গান করেন। প্রতিটি জাতীয় দিবসে তাঁরা একটি করে প্রামাণ্য চিত্রও তৈরি করেন।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তহুরুল হাসানের নজরে আসে গ্রামের হাটের কার্যক্রম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদের ই–কমার্সের সাফল্য দেখে আমি এই নেটওয়ার্কে দেশের সব ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছি। এতে তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে সবার ভাগ্যবদল হতে পারে।’