‘নিজেরা খাইমু কিতা, গরু-বাছুররে খাওয়াইমু কিতা?’

কৃষক সুরুজ আলী গরু-বাছুরের খাবার দিচ্ছেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে সিলেট সদর উপজেলার জাঙ্গাইল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সপ্তাহ খানিক আগে বন্যায় কৃষক সুরুজ আলীর (৭০) বাড়িতে বুকপানি দেখা দেয়। পানিবন্দী হয়ে পড়ায় তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অন্যত্র আশ্রয় নেন। বাড়ির গরু-ছাগলও অন্য জায়গায় সরিয়ে নেন।

আট দিন পর গতকাল শুক্রবার সুরুজ আলী বাড়ি ফিরেছেন। এখন ঘর থেকে পানি নেমে গেছে। তবে উঠানে পানি রয়ে গেছে।

সিলেট সদর উপজেলার কসকালিকা বলাউরা গ্রামের বাসিন্দা সুরুজ আলী। স্ত্রী, সন্তান, ছেলের বউ আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে আট সদস্যের সংসার তাঁর। গত বোরো মৌসুমে আট কাঠা জমির ধান পেয়েছেন। অনেকটা সচ্ছল এই কৃষকের ২টি গরু ও ২টি বাছুর আছে। বন্যার পানিতে তাঁর বাড়িঘর-উঠোনের সঙ্গে গোয়ালঘরও ডুবে যায়। ফলে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি গরুগুলোও পানিবন্দী হয়ে পড়ে। অনেক কষ্টে তীব্র স্রোত ঠেলে স্ত্রী-পরিজন এবং গবাদিপশুদের নিরাপদে সরিয়ে নেন।

১৭ জুন সকালে পানি হুহু করে বাড়ে, দুপুরেই সুরুজ আলী স্ত্রী-সন্তানদের উঁচু এলাকায় অবস্থিত এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। আর নিজের চারটি গরু-বাছুর নিয়ে তিনি পাশের জাঙ্গাইল গ্রামের একটি নির্মাণাধীন ভবনে আশ্রয় নেন।

সুরুজ আলী বলেন, পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ার ১০ দিন আগে তাঁর একটা গাভি বাছুরের জন্ম দেয়। জন্ম নেওয়া এই বাছুরটা তিড়িংবিড়িং করত সারা বাড়িজুড়ে। সেদিন পানি দেখে ভয় পেয়ে চুপ হয়ে পড়ে। পরে অন্য গরু-বাছুরকে পানিতে হাঁটিয়ে নিয়ে এলেও ১০ দিন আগে জন্মানো বাছুরটিকে কোলে করে নিয়ে আসেন। টানা সাত দিন তিনি একটি নির্মাণাধীন ভবনে গরু-বাছুরের সঙ্গে থাকেন। ভবনটির নিচতলায় তাঁর মতো অসংখ্য পরিবার অন্তত ৪০০ গরু-বাছুর, ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।

বন্যার পানিতে মুহূর্তেই ঘর তলিয়ে যাওয়ার সে দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুরুজ বলেন, ‘দেখতে দেখতেই উগার (ধান রাখার স্থান) ভাঙি ঠেলা মারি পাইননে (পানি) নিয়া গেছে। গরু-বাছুরের খাওন খেরখুটাও ভাসাইয়া নিয়া গেছে। থুরাথুরি কিছু খের আনতাম পারছি। আর ই-খানও কিছু খের কিইন্না গরুরে খাওয়াইতাছি। সে দিন বাছুরটারে আইঞ্জা করি ধইরা কুনুমতে পানি ঠেইলা আইছি। ঘরে ফিইরা এখন নিজেরা খাইমু কিতা, গরু-বাছুররে খাওয়াইমু কিতা? বড় চিন্তায় পড়ি গেলাম!’

সুরুজ আলী কথা বলতে বলতে আক্ষেপ আর হাহাকার করেন। তিনি বলেন, বন্যার পানি তাঁকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ঘরের ধান, চাল থেকে শুরু করে হাঁড়ি-পাতিল সব ভেসে গেছে। ভিজে বনষ্ট হয়েছে তোশক, কাপড়চোপড়। ভেসে গেছে গরু-বাছুরের জন্য জমিয়ে রাখা খড়কুটোও। সামনে তাঁর জন্য অন্ধকার সময় অপেক্ষা করছে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।