নিভৃত পল্লির ইতিহাসের বাতিঘর

১৯৪৮ সালে হামলা চালিয়ে আশ্রমটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে টিকে ছিল আশ্রমের অফিসঘর। জামালপুর জেলা সদরের কাপাসহাটিয়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের নিভৃত পল্লি কাপাসহাটিয়া। ঝিনাই নদের তীরের গ্রামটিতে গেলে আর দশটা গ্রামের মতোই দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠের দেখা মিলবে। তবে একটি জায়গায় অনন্যতা পেয়েছে গ্রামটি। সরু একটি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিলবে ৮৭ বছরের পুরোনো একটি অফিসঘরের। সেই ঘর সাজানো মহাত্মা গান্ধীর বিভিন্ন সময়ের ছবি ও তথ্য দিয়ে।

এই অফিসঘর পরিচিত গান্ধী আশ্রম হিসেবে। ১৯৩৪ সালে জামালপুরের নিভৃত পল্লিতে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাসির উদ্দিন সরকার নামের এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন জামালপুর মহাকুমা কংগ্রেসের সম্পাদক। কালের আবর্তে সেই আশ্রমটি পরিণত হয়েছে ইতিহাসচর্চার বাতিঘরে। আশ্রমের পাশাপাশি সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর। পরিপাটি সাজানো–গোছানো আশ্রমটি এই প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠেছে ইতিহাস শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র।

নাসির উদ্দিন সরকার যুবক বয়সেই মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। পরাধীনতার গ্লানি মোচনে দেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সংকল্প নিয়ে অহিংস-সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়ায় ছিল তাঁর লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে তিনি নিজের গ্রাম কাপাসহাটিয়ায় আশ্রম গড়ে তোলেন।

এই আশ্রমে গ্রামের মানুষকে স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে চরকায় সুতা তৈরি, কাপড় বোনা, হস্তশিল্পজাত নানা সামগ্রী তৈরি, হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও স্বাবলম্বনের নানা কার্যক্রম, চিকিৎসাসেবা ও শরীরচর্চা কার্যক্রম চালাতেন। এই আশ্রম তখন পরিণত হয়েছিল ওই অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের আশ্রয়স্থল। এভাবেই ভালোই চলছিল আশ্রমের স্বদেশি চেতনার সব কার্যক্রম। হঠাৎ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই আশ্রমের বিভিন্ন কার্যক্রমে আঘাত আসতে শুরু করে। আশ্রমে একের পর এক হামলা ও আক্রমণ হয়। নাসির উদ্দিন সরকারকেও বেদম মারধর করা হয়। ১৯৪৮ সালে হামলা চালিয়ে আশ্রমটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় আশ্রমের কার্যক্রম। তবে টিকে ছিল আশ্রমের অফিসঘরটি। বাবার পর খুঁড়িয়ে চলা আশ্রমের হাল ধরেছিলেন মেয়ে রাজিয়া খাতুন ও ছেলে মোয়াজ্জেম হোসেন।

প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া আশ্রমটি আবার পুনর্জাগরিত করেছেন নাসির উদ্দিন সরকারের নাতি হিল্লোল সরকার এবং উৎপল কান্তি ধরসহ এলাকার বিভিন্ন স্তরের মানুষ। বর্তমানে আশ্রম পরিচালনার দায়িত্বে আছেন হিল্লোল সরকার। একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সব কার্যক্রম।

আশ্রমের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর। পরিপাটি সাজানো–গোছানো আশ্রমটি এই প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠেছে ইতিহাস শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র
ছবি: প্রথম আলো

সরেজমিনে দেখা যায়, টিকে থাকা অফিসঘরটি সাজানো হয়েছে মহাত্মা গান্ধীর বিভিন্ন কার্যক্রমের ছবি ও তথ্য দিয়েছ। এখানে ভারতবর্ষের ব্রিটিশপূর্ব, ব্রিটিশ-পরবর্তী তৎকালীন পাকিস্তান, ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের নানা আলোকচিত্র প্রদর্শনী করা রয়েছে। এর পাশেই গড়ে উঠেছে মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর। জাদুঘরটি দোতলা। নিচতলায় আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করা সাত বীরশ্রেষ্ঠর ছবি–সংবলিত তথ্য। এর পাশেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির কাষ্টে জীবন উৎসর্গকারীদের নামসহ নানা তথ্য–সংবলিত বোর্ড। জাদুঘরের সিঁড়ির কাছেই খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নম্বর সেক্টরের একটি মানচিত্র, জামালপুর-টাঙ্গাইল অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত নানা ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা তথ্য, বাংলার নবাব মির কাশিম, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাস রয়েছে। সন্ন্যাসী, ফকির বিদ্রোহসহ টিপু পাগলের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাগলপন্থীদের বিদ্রোহের নানা ইতিহাসও রয়েছে।

গান্ধী আশ্রম ও মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরে স্বদেশি আন্দোলনের সময়কার আশ্রমে ব্যবহৃত চরকা, চেয়ার-টেবিল, পুরোনো সিন্দুক, তখনকার ছাত্রীদের তৈরি নানা সূচিকর্ম ছাড়াও আশ্রমের পাঠাগারে রয়েছে দুর্লভ বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ। রয়েছে মুক্তিসংগ্রামের নানা স্মৃতিচিহ্ন, ছবি, বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক কালপর্বভিত্তিক ইতিহাস গ্যালারিও রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই জাদুঘর। একই সঙ্গে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি গ্যালারিও।

প্রতিদিন কাপাসহাটিয়ার গান্ধী আশ্রম ও মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরে শিক্ষার্থী ছাড়াও আসেন অনেক দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী। এই আশ্রম নিভৃতে দর্শনার্থীর মনে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশপ্রেম, সংগ্রামের সাহস ও প্রেরণা।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং জামালপুর জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধায়নে দ্বিতলা জাদুঘর ভবন, অডিটরিয়াম ও একটি অতিথি ভবন করা হয়েছে।

জাদুঘরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক কালপর্বভিত্তিক ইতিহাস গ্যালারিও রয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

নাসির উদ্দিন সরকারের নাতি ও ট্রাস্টি সদস্য হিল্লোল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গান্ধী আশ্রম ও মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর হাজারো দর্শনার্থীর ইতিহাসচেতনাকে করছে সমৃদ্ধ। এটি এখন ইতিহাসের সংগ্রহশালায় পরিণিত হয়েছে। ইতিহাস জানার পাশাপাশি গ্রামের শিক্ষার্থী ও মানুষকে স্বনির্ভর করতে বিনা মূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ইতিহাস সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজসহ নানা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়মিত প্রদর্শন করা হয় ইতিহাসের প্রমাণ্যচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মানবাধিকার, শান্তি-সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধকরণের নানা কর্মসূচি।

অর্থের অভাবে অনেক কাজই করা যায় না উল্লেখ করে হিল্লোল সরকার জানালেন, বিভিন্ন গণকবর, বধ্যভূমি, সম্মুখযুদ্ধের স্থান চিহ্নিত করার কাজও করা হয়। স্বদেশপ্রেমে জাগ্রত হওয়ার জন্য ব্রতচারী প্রশিক্ষণ ও বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এখানে মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন স্মারক, তথ্য, উপাত্ত, আলোকচিত্র, দলিলপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজও চলে।