নিরাপত্তাঝুঁকিতে রোহিঙ্গা নারীরা, বাড়ছে ধর্ষণ-অপহরণ

কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির
ফাইল ছবি

কক্সবাজার শহর থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে টেকনাফের উনচিপ্রাং আশ্রয়শিবির। এই শিবিরে ২২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসতি। তিন দিকে পাহাড়বেষ্টিত এই আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতায় অতিষ্ঠ সাধারণ শরণার্থীরা। যখন–তখন রোহিঙ্গা নারীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ ও মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অপহরণের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ সমস্যার সমাধান করতে পারছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, এই শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীদের আস্তানা। দিনের বেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাম্পে অভিযান চালালে কাঁটাতারের বেড়া ফুটো করে পাশের পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নেয় ওই সব সন্ত্রাসী। আর রাতের বেলায় ক্যাম্পে ঢুকে রোহিঙ্গা মেয়েদের অপহরণ, ধর্ষণসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এই শিবিরে গত ১৫ দিনে অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন, কিন্তু ভয়ে কেউ থানায় মামলা করার সাহস পাননি।

গত সোমবার রাত আটটার দিকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা উখিয়ার ক্যাম্প-১৭ শিবিরের এ-ব্লক থেকে অপহরণ করে রোহিঙ্গা তরুণ ফরিদ আলমকে (২৪)। খবর পেয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা অভিযান চালিয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শিবিরের ইরানি পাহাড়ের আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করেন। কিন্তু এ ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের ধরা সম্ভব হয়নি।

১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মে মাসে নুরানী ও মরকজ পাহাড় থেকে এপিবিএন সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অপহৃত আরও পাঁচ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন। আধিপত্য বিস্তার, মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধসহ নানা কারণে অপহরণের ঘটনা ঘটে জানিয়ে নাইমুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় এখন নারী ধর্ষণের ঘটনা কমে এসেছে। ধর্ষণের ঘটনা গোপনে আপস কিংবা মিটমাট করার খবর তাঁর জানা নেই।

উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়ন, যার সদস্যসংখ্যা দুই হাজারের বেশি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী কয়েক মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। জেলা পুলিশের তথ্যমতে, এ দেশে আসার পর পৌনে পাঁচ বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ৪ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ২ হাজার ৪০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১২৫ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৭৬টি ও ১৮৮ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা হয়েছে ২৫টি। পৌনে ৫ বছরে আশ্রয়শিবিরে খুনের মামলা হয়েছে ৭৪টি। এসব ঘটনায় বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৫৯ রোহিঙ্গাকে। একটি ঘটনায় সর্বোচ্চ ছয়জন রোহিঙ্গা খুনের নজিরও আছে।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, সম্প্রতি আশ্রয়শিবিরে মাদকের ব্যবসা বেড়েছে কয়েক গুণ। কিছু প্রভাবশালী রোহিঙ্গা ক্রিস্টাল মেথ আইসের ব্যবসাও চালাচ্ছে। মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি চলে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ ও নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা। আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা পুরুষদের বহুবিবাহের ঘটনাও বাড়ছে।

গত ২৭ মে টেকনাফের একটি আশ্রয়শিবির থেকে আট বছর বয়সী এক শিশুকে অপহরণ করে পাশের লম্বাবিল জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ এপিবিএন সদস্যরা পরের দিন পাশের পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেন ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত দুই রোহিঙ্গাকে। এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, শিশুটিকে প্রলোভন দেখিয়ে লম্বাবিল নামক জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে গ্রেপ্তারকৃত দুই রোহিঙ্গা।

২ মার্চ রাতে টেকনাফের আরেকটি আশ্রয়শিবির থেকে এক রোহিঙ্গা তরুণীকে অপহরণ করে একদল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। এরপর একটি ঘরে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। ২ এপ্রিল তরুণী বন্দিদশা থেকে কৌশলে পালিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করেন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ধর্ষণে জড়িত মোহাম্মদ দেলোয়ার নামের এক রোহিঙ্গা যুবককে গ্রেপ্তার করে।

২০২১ সালের ২২ মে রাতে উখিয়ার জামতলী ক্যাম্প থেকে এক রোহিঙ্গা তরুণীকে অপহরণ করে টেকনাফের শামলাপুল ক্যাম্পের একটি আস্তানায় আটকে রেখে চার দিন ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল। পরে পুলিশ ওই তরুণীকে উদ্ধার করে। ধর্ষণের অভিযোগে দুই রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হলেও এ ঘটনায় করা মামলার অনেকে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী বলেন, পাহাড়ের ঢালুতে ঘনবসতির ঝুপড়িঘরে রোহিঙ্গা নারীরা নিরাপত্তাহীন। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা কিশোরী-তরুণী ও যুবতী নারীদের আতঙ্কে থাকতে হয়। নারীরা রাতের বেলায় ঘরের বাইরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে কিংবা দূরের নলকূপ থেকে খাওয়ার পানি আনতে গেলে অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের ঘটনাগুলো স্থানীয়ভাবে সালিস বৈঠকে নিষ্পত্তি করা হয়। কিছু ঘটনা বিয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। আর কিছু ঘটনা জরিমানায় সীমাবদ্ধ থাকে।

কুতুপালং ক্যাম্পের মাঝি আনোয়ার বলেন, কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে ও চাকরির প্রলোভন দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা পুরুষ ধর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলেও রোহিঙ্গা মেয়েদের পাচার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী বলেন, রোহিঙ্গা শিবির থেকে মালয়েশিয়া পাঠানোর সময় গত দুই মাসে অন্তত শতাধিক রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বেশ কয়েকজন মানব পাচারকারীকেও ধরাও হয়েছে।