নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনে চা-জনগোষ্ঠী এখনো পিছিয়ে

পানির জন্য স্থাপিত কুয়া। ২৬ ডিসেম্বর বিকেলে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে হুগলিছড়া চা-বাগানেছবি: প্রথম আলো

দেশে চা-বাগান গোড়াপত্তনের ইতিহাস দেড় শতাধিক বছরের। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠী প্রায় পাঁচ লাখ। এই জনগোষ্ঠী এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ নানা সংকটের বৃত্তে আটকে থাকলেও আগের চেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো নিরাপদ পানীয় জল, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের মতো বিষয়ে তাঁরা অনেক পিছিয়ে। এখনো চা-জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষকে প্রতিদিনের চাহিদা পূরণে কুয়া ও ছড়ার (খাল) পানির ওপরই বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে নিরাপদ পানি পান, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব যেমন আছে, তেমনি নিরাপদ পানি ও শৌচাগারের অপর্যাপ্ততাও রয়েছে।

কাজের স্থানেও নারী শ্রমিকেরা পানির সংকটে ভোগেন। চা-বাগানে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি (প্রায় ৫৫ শতাংশ)। সেখানে প্রচুর পানির চাহিদা থাকে। কাঁধে করে কলসিতে পানি এনে শ্রমিকদের সরবরাহের জন্য বিভিন্ন বাগানে কর্তৃপক্ষ লোক রেখেছেন। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। কর্মস্থলে নারী শ্রমিকদের জন্য শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনে উপায় সেকশনের (বাগানের বিভিন্ন এলাকা সেকশনে ভাগ করা আছে) খোলা স্থান ব্যবহার, নয়তো দু-তিন কিলোমিটার দূরে অন্য পাড়ায় (লাইন) যেতে হয়। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রস্রাব আটকে রাখেন। এতে শারীরিক নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। কিছু বাগান এতই প্রত্যন্ত এলাকায়, সেখানে বাইরের কেউই যায় না।

কিছু পরিবার নলকূপের, কিছু পরিবার কুয়ার পানি পান করে। নিরাপদ পানি পান ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহারে সবাই পুরোপুরি সচেতন নন। তবে এখন সচেতনতা বাড়ছে।

গত রোববার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের কয়েকটি চা-বাগান ঘুরে সেখানকার চা-জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। রোববার বাগানের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বিকেলে হুগলিছড়া চা-বাগানের একটি লাইনে (বসতি এলাকাগুলোকে লাইন বলে) বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে ৮০টি পরিবারের বাস। একটি নলকূপ ১০ থেকে ২০টি পরিবার ব্যবহার করে। শুকনো মৌসুমে নলকূপে পানি থাকে না। তখন কুয়ার পানি পান করতে হয়। একটি নলকূপ থেকে একজনকে রশি বাঁধা বালতিতে পানি তুলতে দেখা গেল। একটি কুয়ার আশপাশে বুনো লতাপাতা জন্মে আছে। একটি শৌচাগার ব্যবহারের অনুপযোগী অবস্থায় আছে। সরকারি উদ্যোগে কোনো একসময় এটি বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

একজন কলেজশিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, কিছু পরিবার নলকূপের, কিছু পরিবার কুয়ার পানি পান করে। নিরাপদ পানি পান ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহারে সবাই পুরোপুরি সচেতন নন। তবে এখন সচেতনতা বাড়ছে।

একই বাগানের আরেকটি লাইনে ১৪৮টি পরিবারের বাস। সেখানে প্রায় সবাই নলকূপের পানি পান করে। এই লাইনে শৌচাগার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সচেতনতা বেড়েছে। সেখানে এক বছর আগে মাত্র পাঁচটি স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ছিল। এখন ৪০ থেকে ৫০টি শৌচাগার হয়েছে।

নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন এক নারী চা-শ্রমিক নারী। ২৬ ডিসেম্বর বিকেলে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে হুগলিছড়া চা-বাগানে
ছবি: প্রথম আলো

আমরইল ছড়া, হুগলিছড়া, রাজঘাটসহ কয়েকটি বাগানের ‘ফাঁড়ি’ (শাখা বাগান) ঘুরে একই রকম তথ্যই পাওয়া গেছে। চা-শ্রমিকেরা বলেন, বিভিন্ন বাগানে কর্তৃপক্ষ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা গভীর-অগভীর নলকূপ দিয়েছে। তাতেই পানির চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। আবার অনেক স্থানে শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে গেলে নলকূপে পানি ওঠে না। অনেক স্থানে উঁচু টিলা ও পাথুরে ভূমি হওয়ায় নলকূপ বসানো যায় না। অনেক নলকূপ অকেজো হয়ে আছে। কিছু বাগানে নলকূপে আয়রনের পরিমাণ বেশি। পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয় না। এসব স্থানে চা-শ্রমিকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কুয়ার পানি ব্যবহার করেন। এই কুয়াগুলোরও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা নেই। কুয়ার মুখ খোলা থাকে।

রাজঘাট চৌমোহনাতে একটি স্টলে বসে রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও চা-শ্রমিক নেতা বিজয় বুনার্জীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরাপদ পানির সংকট প্রায় সব বাগানেই আছে। বেশির ভাগ মানুষ নালা ও কুয়ার পানি খান, ব্যবহার করেন। নলকূপের পানিতে আয়রন বেশি। স্যানিটেশনের অবস্থাও খারাপ। বাগানে এসব নিয়ে কাজ করতে ম্যানেজমেন্টও বিরোধিতা করে। তবে আগের চেয়ে অগ্রগতি হচ্ছে। সেকশনে যাওয়া কমছে। মানুষের মনমানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে। নিজেরা পাকা শৌচাগার করছে।’

বিজয় বুনার্জী বলেন, রাজঘাট ইউনিয়নের আলুবাড়ি এলাকায় মানুষ নালার পানি পান করত। ২০১৬ সালে বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যাফেয়ার্সের (আইডিইএ) মাধ্যমে সেখানে সৌরবিদ্যুৎ–চালিত গভীর নলকূপ স্থাপন করে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। একে ‘সোলার পানি’ বলছেন লোকে।

আইডিইএ জানিয়েছে, তারা ২০১৬ সাল থেকে শ্রীমঙ্গলে নিরাপদ পানি পান, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহার এবং পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম শুরু করে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার মাইজদিহি, কালীঘাট, বিদ্যাবিল, হরিণছড়া, নাহার, পুটিয়াছড়া, লাখাই, রাজঘাট, হুগলিছড়া ও সাতগাঁও—এই ১০টি চা-বাগানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রম চাচ্ছে তারা। পাশাপাশি নাহার, পুটিয়াছড়া, আলুবাড়ি, মেকনিছড়া, হরিণছড়া ও মাইজদিহি চা-বাগানে পানি সরবরাহ এবং স্কুল টয়লেট (বাচ্চাদের শৌচাগার) তৈরি করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের কার্যক্রম শুরুর সময় এই ১০টি বাগানে ৮ হাজার ৯০টি পরিবার ছিল। এই পরিবারগুলোর মধ্যে ৭৭৪টি ভালো শৌচাগার ছিল। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। সংস্থার উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমে ফলে এখন প্রায় ৭৫ শতাংশের বাড়িতে ভালো শৌচাগার আছে।

আইডিইএর প্রকল্প ব্যবস্থাপক পংকজ ঘোষ দস্তিদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এখন সচেতনতা বাড়ছে। আগে মনে করত মালিক সবকিছু দেবে। এখন নিজের অর্থে শৌচাগার করছে। ভাঙলে মেরামত করছে। নিরাপদ পানির ধারণাও ছিল না। এসব বাগানে আমাদের ২৭ জন স্বেচ্ছাসেবেক সবাইকে পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন সম্পর্কে সচেতন করছে।’

পংকজ ঘোষ দস্তিদার জানান, পুটিয়াছড়া উঁচু টিলা এলাকায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার (রেইন হার্ভেস্টিং) প্রকল্পের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় এক রিং এক স্ল্যাবের শৌচাগার দেওয়া হয়েছে। সেখানে মালিকপক্ষ আরও একটি রিং দেওয়ায় দুই রিংয়ের শৌচাগার করা হয়েছে।

স্ট্যাটিসটিক্যাল হ্যান্ডবুক অব বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রি সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ১৬৬টি চা-বাগান আছে। তার মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯১টি। নারী-পুরুষ চা-শ্রমিকের সংখ্যা নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার ১৬৪। চা-বাগানগুলোর মোট বাসিন্দা ৪ লাখ ৭২ হাজার ১২৫ জন।

বেশির ভাগ লোকই কুয়ার পানি ব্যবহার করেন এই কুয়াও বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্মিত না। অর্ধেক নলকূপই নষ্ট হয়ে আছে। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত শ্রমিকেরা কাজ করেন। কর্মস্থলে সারা দিন প্রচুর পানির প্রয়োজন। অনেক বাগান পানির ব্যবস্থা করে। তবে তা কতটুকু নিরাপদ, তা নিশ্চিত নয়। তাঁরা যেকোনো স্থানের পানি নিয়ে আসে। কর্মস্থলে স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও নেই।
রামভজন কৈরী, বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী উপদেষ্টা

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী উপদেষ্টা রামভজন কৈরী প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ পানির সংকট কমবেশি সব বাগানেই আছে। বেশির ভাগ লোকই কুয়ার পানি ব্যবহার করেন এই কুয়াও বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্মিত না। অর্ধেক নলকূপই নষ্ট হয়ে আছে। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত শ্রমিকেরা কাজ করেন। কর্মস্থলে সারা দিন প্রচুর পানির প্রয়োজন। অনেক বাগান পানির ব্যবস্থা করে। তবে তা কতটুকু নিরাপদ, তা নিশ্চিত নয়। তাঁরা যেকোনো স্থানের পানি নিয়ে আসে। কর্মস্থলে স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও নেই। নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে মালিকপক্ষের সঙ্গে চুক্তি আছে। যদিও তার বাস্তবায়ন নেই।

তবে মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা-সংসদের সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি জি এম শিবলী দাবি করেন, আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। নলকূপের পানি ছাড়া কেউ খায় না। আশপাশে নলকূপ না থাকলে দূর থেকে পানি নিয়ে আসে। কুয়া বা ছড়ার পানি কেবল গোসল ও ধোয়ামোছার কাজে ব্যবহার করে। অন্যদিকে শৌচাগার শ্রমিকেরা ব্যবহার করেন কম। শৌচাগারে শ্বশুর গেলে বউরা যায় না। তবে এই সংখ্যা কমছে। আগের চেয়ে সবার শৌচাগার ব্যবহার বেড়েছে। সব মানুষ তো সমান নয়। সব বাগানের সামর্থ্যও সমান না।

জি এম শিবলী বলেন, তাঁদের ভাড়াউড়া বাগানে এ বছর ৭০০ শৌচাগার দেওয়া হয়েছে। পুরোনোগুলো সংস্কার করা হচ্ছে। সরকারিভাবে ৫০ শতাংশ ভর্তুকির ১০০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় বাগানেই এই নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন