নির্বিচার পোনা নিধন

নদীতে ছোট ফাঁস জালের অবাধ ব্যবহারে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন, বংশবিস্তার ও বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।

ছোট ফাঁসের নিষিদ্ধ জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে তিন নদীর মোহনা। ৯ এপ্রিল পাথরঘাটার ইলিশের চরে
ছবি: প্রথম আলো

পায়রা, বিষখালী নদী ও বলেশ্বর নদ এসে মিলেছে বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটায়। এখান থেকেই পতিত হয়েছে সাগরে। জোয়ার-ভাটায় এই তিন নদীর মোহনায় ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসে মাছ, সঙ্গে পোনা। সেখানে নিষিদ্ধ জাল পেতে মাছ ধরতে গিয়ে অবাধে পোনা নিধন করছেন একশ্রেণির জেলে।

স্থানীয় সাধারণ জেলে ও সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, নদীতে ছোট ফাঁস জালের অবাধ ব্যবহারে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন, বংশবিস্তার ও বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। পাথরঘাটার বলেশ্বর নদ, বিষখালী নদী ও তালতলীর পায়রা নদী এবং সুন্দরবনের কচিখালী ও কটকা খালে নিষিদ্ধ জালে যেভাবে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের পোনা হত্যা চলছে, এতে অচিরেই মাছের ভান্ডার শূন্য হয়ে পড়বে। প্রতিদিন কী পরিমাণ পোনা মাছ নিধন হচ্ছে, তা নিজের চোখে না দেখলে কল্পনা করাও কঠিন।

মৎস্য আইনে মাছের পোনা সংরক্ষণে সোয়া চার ইঞ্চির কম ফাঁস জাল ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ ওই এলাকায় আধা ইঞ্চি থেকে পৌনে এক ইঞ্চি ফাঁস জাল ব্যবহার করা হচ্ছে।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী উষ্মা প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৪ মার্চ জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় নিষিদ্ধ জালে মাছ শিকার বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু গত এক মাসেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

গত রবি ও সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, বলেশ্বর নদের হরিণঘাটা থেকে বিহঙ্গ দ্বীপ ও ইলিশের চর হয়ে উত্তরে চরদুয়ানি পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার, বিষখালী নদীর লালদিয়া থেকে উত্তর পাড়ে দক্ষিণ কূপদোন পর্যন্ত এবং নদীর দক্ষিণ পাড়ে বরগুনা সদরের গোড়াপদ্মা হয়ে নলী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এবং পায়রা নদীর বরগুনা সদরের চালিতাতলী থেকে সোনাতলা পর্যন্ত এবং অপর পাড়ে তালতলী থেকে দক্ষিণে তেঁতুলবাড়িয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এবং সুন্দরবনের কচিখালি ও কটকার বিশাল এলাকাজুড়ে নিষিদ্ধ ঘোপ, বাঁধা, গড়া ও বেহুন্দি জাল পেতে রাখা হয়েছে।

এসব জালের ফাঁস আধা ইঞ্চি থেকে পৌনে এক ইঞ্চি। ওই ছোট ফাঁসের এ নিষিদ্ধ জালে অবাধে পোনা মাছ নিধন চলছে। সাধারণত ইলিশের পোনা, পোয়া, টেংরা, গুলিশাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরেন। জালে এসব মাছের পাশাপাশি অনেক মাছের পোনাও আটকা পড়ে। কিন্তু এসব পোনা কোনো কাজে লাগে না বলে তাঁরা ফেলে দেন।

বন বিভাগের পাথরঘাটার লালদিয়া এলাকার বিষখালী নদীতে বেহুন্দি জাল দিয়ে অনেককে মাছ ধরতে দেখা যায়। সেখানে এক জেলে বলেন, ‘সবাই ধরে, আমিও হেইতে ধরি। আমাগো এলাকায় এই রহম তিন শর বেশি নৌকায় ভাসা জাল দিয়া মাছ ধরে।’ কয়েকজন জেলে বলেন, জালে জাটকা, পোয়া, তপসি, টেংরাসহ অন্য প্রজাতির অনেক মাছ আর পোনা ধরা পড়ে। যেসব পোনা বিক্রি করে লাভ নেই, তাঁরা সেগুলো ফেলে দেন।

পাথরঘাটার পদ্মা এলাকায় দেখা যায়, বাঁশের খুঁটি গেড়ে ভাসা ও বেড় জাল পেতে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি স্রোতের মুখে বেহুন্দি জাল পেতেও মাছ ধরছেন জেলেরা। এ এলাকা হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনের আওতাভুক্ত।

বরগুনা সদরের নলটোনা ইউনিয়নে পায়রা নদীর গোড়াপদ্মা এলাকায় দেখা যায়, সেখানে সাড়ে ৪ কিলোমিটার এলাকায় ১৮ জন জেলে গড়া জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। তাঁদের মধ্যে ছয় জেলে বাবুগঞ্জ বিটের সংরক্ষিত বনের আওতাভুক্ত এলাকায় জাল পাতেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলে বলেন, পাথরঘাটার বড়টেংরা বন বিভাগের নৌযানচালক রুহুল আমিনসহ বন বিভাগের চারটি কার্যালয়ের ওয়াচার ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে রফাদফা করেই এসব জাল পাতেন তাঁরা। এ জন্য প্রত্যেক জেলে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে দেন। তবে রুহুল আমিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি এ ঘটনায় জড়িত নই। বিভাগের কয়েকজন ওয়াচার আছে, যারা বেতন পায় না, তারা এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে।’

পাথরঘাটার প্রতিটি ফরেস্ট ক্যাম্পে চিঠি দিয়ে নিষিদ্ধ জালের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল হক। তিনি বলেন, তারপরও এ ঘটনায় কেউ জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে মৎস্য বিভাগের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক আনিসুর রহমান তালুকদার গত মঙ্গলবার সকালে বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে এতটা ভয়াবহ তা বুঝতে পারিনি। আমি দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলব।’ মৎস্য বিভাগের জনবলসংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এসব মাছ বড় হলে জেলেরাই লাভবান হবেন। জেলেদের মধ্যে এই সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার।