নিস্তব্ধতায় প্রকৃতি পেল আপন রূপ

পাথারিয়া পাহাড়ের বুক থেকে গড়িয়ে নামছে জল। গতকাল শনিবার মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতেছবি: প্রথম আলো

অসহনীয় শব্দ, কোলাহল নেই। হয়তো এ কারণেই অনেকটা দূর থেকেও জলপতনের শব্দ কানে ভেসে আসে। পাহাড়ের বুক চিরে জল নামছে গমগম করে। ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলে সেই শব্দ আরও মধুর হয়ে বাজে। কাছেই ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। সেই ডাক বনের ভেতর শব্দ-তরঙ্গ তৈরি করছে। গাছের ডালে ডালে লাফিয়ে খেয়ালি বানর পাতা ছিঁড়ছে। পথে ফাঁকফোকরে মাথা তুলেছে বুনো ঘাস, বুনো লতাপাতা। পাথরে পাথরে চরে বেড়াচ্ছে শামুক, পাহাড়ি কাঁকড়া।

বহুকাল পর এভাবেই নিজের স্বর্গীয় রূপ ফিরে পেয়েছে মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। জলপ্রপাত ঘিরে সবখানেই এখন প্রাকৃতিক নির্জনতা। প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সৌন্দর্যে। করোনা সংক্রমণের কারণে দ্বিতীয় ধাপে গত এপ্রিল মাস থেকে দেশের অন্য সব পর্যটনকেন্দ্রের মতো মাধবকুণ্ড ইকোপার্কও বন্ধ। পর্যটক আসছেন না।

জলপ্রপাত-সংলগ্ন মাধবকুণ্ড আদিবাসী খাসিয়াপুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) ওয়ান বর এল গিরি এখানেই বড় হয়েছেন। নিজেদের তাঁরা প্রকৃতির সন্তান বলেই জানেন। চোখের সামনেই মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত কীভাবে বদলে গেছে, দেখেছেন। কী রকম প্রাণ-প্রকৃতির ‘প্রাণ’ ক্ষয় হচ্ছে, তাই দেখে দেখে তাঁদের দিন কাটে।

পর্যটকদের ভিড় নেই। নেই কোলাহল। তাই প্রকৃতি ফিরেছে আপন রূপে। গতকাল শনিবার মৌলভীবাজারের বড়লেখার মাধবকুণ্ড ইকোপার্কে
ছবি: প্রথম আলো

মান্ত্রী ওয়ান বর এল গিরি আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনে এখন মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক বন্ধ। এই সুযোগে খুব সুন্দর হয়ে উঠেছে পরিবেশ। দেখতে দারুণ লাগে। অনেকটা ছোটবেলায় মাধবকুণ্ডকে যে রকম দেখেছি, সে রকমই লাগছে এখন। দল বেঁধে বনমোরগ ঘুরছে। সন্ধ্যার আগে আগে বনমোরগ বেশি দেখা যায়। বানরের সংখ্যাও বেশি। সারা দিন গাছে থাকে। খুব সুন্দর। মানুষের পদচারণ না থাকায় ঘাস জন্মেছে। পানিও অনেক স্বচ্ছ। শত শত শামুক, কাঁকড়া ঘুরছে-ফিরছে। খুব দারুণ দেখতে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের চলাচলের পথে শেওলা জমেছে। পথের স্থানে স্থানে বুনো ঘাস গজিয়েছে। নানা রকম গাছ-লতাপাতা চলে এসেছে পথের ওপর। রাস্তার মধ্যে, রাস্তার পাশে, ঝরনার পাথরে ছোটবড় শামুক ছড়ানো-ছিটানো। পাহাড়ি কাঁকড়া ছোটাছুটি করছে। কারও একটু সাড়া পেলেই ফাঁক-ফোকরে গা ঢাকা দিচ্ছে। জলপ্রপাতের ছড়ার বিভিন্ন স্থানে জাল পেতে মাছ ধরছেন আদিবাসী যুবকেরা। জলপতনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

ইকোপার্কের ভেতরটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে এখন। মানুষের চলাচল না থাকায় শেওলা জমে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে আছে। প্রচুর শামুক, পাহাড়ি কাঁকড়া ছোটাছুটি করছে। বানর ও বনমোরগ স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করছে। পর্যটক আসলে এভাবে দেখা যায় না।
সাইদুল ইসলাম, গেটম্যান, মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক

মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের গেটম্যান সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইকোপার্কের ভেতরটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে এখন। মানুষের চলাচল না থাকায় শেওলা জমে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে আছে। প্রচুর শামুক, পাহাড়ি কাঁকড়া ছোটাছুটি করছে। বানর ও বনমোরগ স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করছে। পর্যটক আসলে এভাবে দেখা যায় না।

প্রকৃতিতে আবার প্রাণ ফিরে এসেছে। গতকাল শনিবার মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মাধবকুণ্ডে
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ঈদের সময়টাতে পর্যটকদের ঢল নামে মাধবকুণ্ড ইকোপার্কে। কিন্তু লকডাউনের কারণে পর্যটকেরা আসেননি। ইকোপার্ক এলাকাটি এখন শান্ত, কোলাহলমুক্ত। মানুষের হইচই নেই। যানবাহন আসা-যাওয়ার যান্ত্রিক শব্দ নেই। তবে করোনাকালে সংকটে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক দুই দফা বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা। প্রায় ১৫ জন আলোকচিত্রী আছেন, যাঁরা পর্যটকদের ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন। আছেন বিভিন্ন ধরনের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী। শতাধিক ব্যবসায়ী এখন বেকার সময় পার করছেন।

আলোকচিত্রী জুয়েল আহমদ বলেন, ‘পর্যটক না আইলে (আসলে) আমাদের রুজি বন্ধ। মাধবকুণ্ড বন্ধ থাকায় খুব কষ্টে আছি। ঋণ করি চলরাম (চলতেছি)।’

মাধবকুণ্ড জেলা পরিষদ ডাকবাংলো-সংলগ্ন ব্যবসায়ী কবির আহমদ বলেন, ‘আমরা এক বছর ধরে লসের মধ্যে আছি। প্রতি ঈদে ১০-১২ দিন আমাদের ব্যবসা ভালো হয়। এই রুজি দিয়াই মূলত বছরের বেশির ভাগ সময় চলি। কিন্তু করোনার কারণে ঈদে ব্যবসা করতাম পারছি না। খুব কষ্টে আছি। কাপড়ের দোকান। মাঝেমধ্যে দোকান খুলি, ঘরে আলো–বাতাস ঢোকাই। ঈদের সময় অনেক মানুষ আইরা (আসতেছেন)। কেউ ভেতরে ঢুকতে পাররা না। মন বুঝ দেওয়ার লাগি (জন্য) দোকান খুলি। যদি বিক্রি করতে পারি।’

বন বিভাগের বড়লেখা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাধবকুণ্ড বন্ধ থাকায় ভেতরটা অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। প্রতিদিনই আমরা যাই। প্রকৃতিতে প্রাণ ফিরে এসেছে। বন্ধ থাকায় এত দিন লোকজনও আসেনি। ঈদ উপলক্ষে আশপাশের কিছু তরুণ-কিশোরেরা আসছে। ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। রাস্তার পাশে শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগানো হয়েছিল। সেগুলোয় ফুল ফুটেছে। সেখানে ছবি তুলে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের লোকজন সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। কোনো লোক ভেতরে ঢুকতে পারছে না।’