নিহত যুবকের বাড়ির সামনে ‘চোরাকারবারীর বাড়ী’

বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের বাড়ির সামনে ‘চোরাকারবারীর বাড়ী’ লেখাসংবলিত একটি বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে বিজিবি। শ্যামকুড় গ্রাম, মহেশপুর, ঝিনাইদহপ্রথম আলো

হতদরিদ্র কৃষক মেহেদী হাসান ওরফে সুমন (২২)। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন গরু চোরাকারবারিদের শ্রমিক। ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পারাপার করতেন। গত বছরের ৮ নভেম্বর ভারতে গরু আনতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত হন মেহেদী। তিন দিন পর লাশ ফেরত পায় তাঁর পরিবার।

উপার্জনক্ষম ওই যুবকের অকালমৃত্যুতে পরিবারটি যখন গভীর শোকে, তখনই ওই পরিবারের সঙ্গে ঘটে আরও একটি ঘটনা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে মেহেদীর বাবা আবদুল মান্নানের বাড়ির সামনে একটি গাছের সঙ্গে টাঙিয়ে দেওয়া হয় একটি সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা ‘চোরাকারবারীর বাড়ী’। ঘটনাটি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় গ্রামে। মেহেদীর দাফন শেষ হওয়ার পরদিন বিজিবি ওই বোর্ডটি টাঙিয়ে দেয়, যা এখনো আছে।

সুমনের পরিবারের কাছে চোরাকারবারিদের নাম জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা দেননি। উল্টো চোরাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চেপে গেছেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল আহসান, অধিনায়ক, বিজিবি ৫৮ ব্যাটালিয়ন

মেহেদীর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, প্রথমে দেওয়া হয় ‘গরু চোরাকারবারীর বাড়ী’ লেখা একটি বোর্ড। যা ঝড়-বৃষ্টিতে নষ্ট হলে আবার দেওয়া হয়েছে আরও একটি বোর্ড। সেখানে লেখা ‘চোরাকারবারীর বাড়ী’। বোর্ডটি তাঁদের পাহারা দিতে বলা হয়েছে। বোর্ডটি কেউ সরিয়ে ফেললে বা কোনো ক্ষতি হলে গৃহকর্তাকেই জবাবদিহি করতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে বিজিবি। এতে লজ্জায় পাড়ায় বের হতে পারেন না পরিবারের লোকজন। আক্ষেপ করে মেহেদীর বাবা আবদুল মান্নান বলেন, মাঝেমধ্যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোথায় যাবেন? কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাঁর। তাই চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন।

শ্যামকুড় গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে ঢোকার পথে একটি মেহগনি গাছে বোর্ড সাঁটানো আছে। সেই বোর্ডের ওপরে একটি সাদা কাগজে লেখা—‘চোরাকারবারীর বাড়ী’, যা লেমিনেটিং করে লাগানো হয়েছে।

আবদুল মান্নান বলেন, দারিদ্র্যের সঙ্গে তাঁদের বসবাস। নিজে দিনমজুরি করে সংসার চালান। নিজেদের চাষযোগ্য কোনো জমি নেই। পাঁচ শতক জমির ওপর টিনের দুটি ছাপরা ঘরে থাকেন তাঁরা। তাঁর তিন ছেলে ছিল। বড় ছেলে মেহেদী হাসান সুমন বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। মেজ ছেলে খালিদ হাসান ইমন (১৯) এখনো কৃষিকাজের সঙ্গেই আছেন। ছোট ছেলে জাহিদ হাসান (১১) পড়ালেখা করে। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের স্ত্রী-সন্তানসহ সব মিলে ওই বাড়িতে ১১ জনের বসবাস। বাড়িতে বিবাহযোগ্য মেয়েও আছে। স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েও আছে। ওই সাইনবোর্ড তাঁদের মাথা নিচু করে দিচ্ছে। গ্রামের লোকজনের নানা কথায় বাড়ির বাইরে বের হতে তাঁরা লজ্জা পান।

বিএসএফের গুলিতে নিহত মেহেদী হাসানের বাবা-মা বাড়ির সামনে দাঁড়ানো। পাশে একটি গাছে ঝুলছে ‘চোরাকারবারীর বাড়ি’ লেখাসংবলিত একটি বোর্ড । শ্যামকুড় গ্রাম, মহেশপুর, ঝিনাইদহ
প্রথম আলো

পরিবার সূত্র জানায়, মেহেদী হাসান ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। স্থানীয় গরু ব্যবসায়ীরা তাঁকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে এলাকায় নিয়ে আসেন। বাড়িতে আসার পর কয়েক দিন থেকে আবার ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মেহেদী। গত বছরের ৭ নভেম্বর বিকেলে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে আর ফেরেননি। ৮ নভেম্বর সকালে বাড়িতে খবর আসে মেহেদী ভারত থেকে গরু আনার পথে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এরপর লাশ ফেরতের জন্য বিজিবি স্থানীয় লড়াইঘাটা ক্যাম্পে যোগাযোগ করে। বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, লাশ ফেরতের চেষ্টা চলছে। তিন দিন পর লাশ ফেরত পাওয়ার পর তা দাফন করা হয়। লাশ দাফনের পরদিন খালিশপুর ৫৮ ব্যাটালিয়ন বিজিবির কয়েকজন কর্মকর্তা ও সদস্য এসে বাড়ির সামনে মাটিতে একটি বোর্ড গেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই বোর্ডটির কোনো ক্ষতি হলে গৃহকর্তা আবদুল মান্নানই দায়ী থাকবেন। এ কথা জানার পর তাঁরা বোর্ডটি মাটিতে নয়, গাছে লাগিয়ে দেওয়ার দাবি করেন, যাতে শিশুরা সেটা নষ্ট না করে। পরে সেই বোর্ড গাছে লাগিয়ে দেওয়া হয়।

মান্নানের স্ত্রী সাইফুন নেছা জানান, বিজিবি অপবাদ দিয়েছে, তাঁরা নাকি চোরাকারবারির কাছ থেকে পয়সা নিয়ে তাদের নাম প্রকাশ করেননি। এ অভিযোগে বিজিবি তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করেছে। তিনি বলেন, ‘ছেলে হারিয়ে যখন কান্নাকাটি করেছি, তখন বিজিবি আমাদের ওপর অমানবিক চাপ সৃষ্টি করেছে, যা খুবই কষ্ট দিয়েছে।’

গ্রামের বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, তাঁরাও এটা (বোর্ডটি) দেখে লজ্জা পান। এভাবে গোটা পরিবারকে অপবাদ দেওয়া ঠিক নয়। শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আমানুল্লাহ বলেন, বিষয়টি তাঁদেরও কষ্ট দেয়। কিন্তু বিজিবির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তারা বুঝতে চায় না। বিষয়টি সমাধানের দাবিও জানান তিনি।

ঝিনাইদহ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহ মিন্টু বলেন, এটা কোনোভাবেই কেউ লিখতে পারেন না। আইনে আছে, একজনের অপরাধ আরেকজন নেবে না। এ ক্ষেত্রে ওই পরিবারটি নিরপরাধ। ফলে এটা আইনেও সমর্থন করে না।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার ঝিনাইদহ সদর ইউনিটের সভাপতি আমিনুর রহমান জানান, এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের অপরাধ না থাকলেও শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন এলিনা খান বলেন, চোরাকারবারির শাস্তি হোক, এটা তাঁরাও চান। কিন্তু কারও বাড়িতে এভাবে বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া যায় না। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

জানতে চাইলে বিজিবি খালিশপুর ৫৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, সুমনের পরিবারের কাছে চোরাকারবারিদের নাম জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা দেননি। উল্টো চোরাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চেপে গেছেন। সীমান্তে গরু আনতে গিয়ে কেউ মারা গেলে দেশের বদনাম হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অন্য কারও বাড়িতে এভাবে লাগানো হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কামরুল আহসান বলেন, ‘ইচ্ছা আছে, অর্থ বরাদ্দ পেলে আরও লাগানো হবে।’