নিয়মরক্ষার দরপত্রে ১৫ কোটি টাকার কাজ বাগানোর অভিযোগ

প্রতীকী ছবি

বগুড়ায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১৫ কোটি টাকার দুটি ঠিকাদারি কাজের জন্য দরপত্র জমা পড়েছিল মোটে চারটি। অর্থাৎ কোটি টাকার একেকটি কাজ পেতে মোটে দুটি করে প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল। স্থানীয় ঠিকাদারদের অভিযোগ, সরকারদলীয় নেতারা ‘সমঝোতা’র মাধ্যমে কাজ দুটি পকেটে পুরেছেন। এ জন্য ই-জিপির (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) বদলে ‘ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে’ দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। দরপত্র ফেলার বাক্সটি রাখা হয়েছিল কেবল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়েই। আর দরপত্র দাখিলের দিন ওই কার্যালয়টি কার্যত ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীদের দখলে। দরপত্র বাক্সের ধারেকাছে কাউকে ভিড়তে দেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সমঝোতার অভিযোগ অস্বীকার করলেও সরকারদলীয় নেতারা তা একরকম স্বীকার করে নিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, যৌথ উদ্যোগের (জয়েন্ট ভেঞ্চার) দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে এই কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার রহমান।

মুঠোফোনে জুলফিকার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় কাজ, সমঝোতা হয়েছে। সংগঠন চালাতে হয়, আমরা তো চুরি আর করিনি।’ তবে কোনো ঠিকাদারকে দরপত্র দাখিলে বাধা প্রদান করা হয়নি বলে দাবি তাঁর।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অর্থায়নে দেশের ২৩টি পৌরসভায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প (আরবান ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট) বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প চলছে। এই প্রকল্প এ বছরের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে বগুড়ার শেরপুর পৌরসভায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শেরপুর পৌর শহরে ১৫ কিলোমিটার পাইপলাইনে পানি সরবরাহ এবং আরও সাড়ে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৬০০ বাড়িতে মিটারসহ সংযোগ এবং পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট ও জলাধার নির্মাণে।

কয়েকজন ঠিকাদারের অভিযোগ, সরকার সাম্প্রতিক সময়ে ই-জিপি নির্দেশনা জারি করে। নির্দেশনা মেনে সরকারি তহবিলের অর্থ ব্যয়, পণ্য, কার্য বা সেবা কেনাকাটার ক্ষেত্রে ই-জিপি পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলা হয়। তবে এই কাজে ই-জিপির বদলে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই দরপত্রের শিডিউল বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় ছাড়াও একাধিক স্থান থেকে সংগ্রহের সুযোগ রাখা হয়। কিন্তু দাখিলের জন্য শুধু নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় নির্ধারণ করা হয়।

গত সোমবার ছিল দরপত্র দাখিলের দিন। সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়া শহরের সেউজগাড়িতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কার্যালয়ের বাইরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের দেড় থেকে দুই শ নেতা–কর্মী ভিড় জমিয়েছেন। তাঁরা যে শ খানেক মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছেন, সেগুলো এখানে–সেখানে রাখা হয়েছে। কার্যালয়ে ফটক দিয়ে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ভেতরে অবস্থান নিয়েছেন কয়েকজন নেতা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কক্ষের বাইরে ও ফটকে কয়েকজন পুলিশকে কেবল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কার্যত কার্যালয়টির দখল ছিল বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার রহমানের হাতে।

তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সমঝোতা বা যোগসাজশের বিষয়টি স্বীকার করেননি। শুক্রবার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরপত্র কতটা বিক্রি হয়েছে, সেটা জানতে আরও সময় লাগবে। দুটি প্যাকেজে চারটি দরপত্র দাখিল হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৮ কোটি টাকার প্যাকেজে প্রাথমিকভাবে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রাইম আনোয়ার জয়েন্ট ভেঞ্চার। অন্যদিকে সাড়ে ৬ কোটি টাকার প্যাকেজে সর্বনিম্ন দরদাতা সিডিসি এমএসই জয়েন্ট ভেঞ্চার।’

১৫ কোটি টাকার কাজে মাত্র চারটি দরপত্র দাখিল প্রসঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘কতটা দরপত্র বিক্রি হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই, সেটা প্রকল্প–সংশ্লিষ্টরা ভালো বলতে পারবেন। তবে এ ধরনের কাজ পেতে হলে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। অভিজ্ঞতার শর্তের কারণে কম দরপত্র দাখিল হয়ে থাকতে পারে।’

মুঠোফোনে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্র দাখিলে কোনো ঠিকাদারকে বাধা দেওয়া হয়েছে, এ ধরনের অভিযোগ তাঁর কাছেও কেউ করেননি। ই–জিপি না করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এখন ইজিপি পদ্ধতি দরপত্র আহ্বান করার নিয়ম। কিন্তু প্রকল্পের অর্থদাতা আইডিবি। তাদের গাইডলাইন ছিল ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করতে হবে। এ কারণে একাধিক জায়গায় দরপত্র দাখিলের সুযোগ রাখা যায়নি।’

এর আগে গত বছরের ২৭ আগস্ট একইভাবে এই প্রকল্পের ৮ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে।

এসব বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে ই-জিপি ছাড়াই কোনো কোনো প্রকল্পে টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে। মাত্র চারটি দরপত্র দাখিলই বলে দেয় যে কোথাও ঘাপলা আছে।’