নুন আনতে পান্তা ফুরানোর জীবনে মিলেছে পাকা ঘর

অসচ্ছল ও দুস্থ পরিবারের জন্য সরকারি সহায়তায় তৈরি পাকা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এক উপকারভোগী। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ দক্ষিণে
প্রথম আলো

লেচু বেগম ভিক্ষা করে চলেন। আছে বলতে মাটির একটা ঘর। সেই জরাজীর্ণ ঘরটিই কোনোরকম মাথা গোঁজার আশ্রয়। কখনো কল্পনাতেও আসেনি এই ঘর বদলে নতুন ঘর করার কথা। ভাবতেও পারেননি কখনো পাকা ঘরে ঘুমাতে পারবেন তিনি। হঠাৎ করেই কোনো এক জাদুস্পর্শে যেন তাঁর ঘরটি বদলে গেছে। তিনি এখন পাকা ঘরে থাকেন। ভাবতেও বিস্ময় লাগে, সেই ঘরের মালিকও তিনি।

লেচু বেগমের বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুরে। তিনি বলেন, ‘মানুষের সাহায্যে সংসার চলে। এত দিন মাটির ঘরো থাকছি। নুন আনতে যেনো পান্তা ফুরায়, ওখানো পাকা ঘর কল্পনার বাইরে আছিল। এ রকম পাকা একটা ঘর অইবো, চিন্তায়ও আনি নাই। কিন্তু না চাইতেই ঘর অইছে।’

ওই নারী পাকা ঘর পেয়ে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। তাঁর মতো ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, দিনমজুর, রিকশাচালক, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত নারী, বিধবা, অন্যের বাড়িতে কাজ করেন, অতিদরিদ্র নারীসহ ২৬২টি অসচ্ছল ও দুস্থ পরিবার সরকারের সহায়তায় এ রকম পাকা ও আধপাকা ঘর পেয়েছে।

বড়লেখা উপজেলা প্রশাসন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় ও সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলার দরিদ্র, অসচ্ছল ও পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ২৬২টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পসমূহের মধ্যে একটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ২২৩টি ঘর। এই ঘর নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ টাকা করে। এই ঘরগুলোতে আছে পাকা ভিটা ও বারান্দা, টিনের বেড়া, থাকার কক্ষ ও একটি শৌচাগার।

ঘর পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে। স্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু। অনেক কষ্টের জীবন আমার। একটি পাকা ঘর পেয়ে আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই খুশি।
আবদুল জলিল, দক্ষিণ শাহবাজপুরের দরিদ্র উপকারভোগী

এ ছাড়া গ্রামীণ দরিদ্র গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্যোগসহনীয় গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ১০টি ইউনিয়নে অসহায় ও দরিদ্র ২৪টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ২০১৯-২০ অর্থবছরে টিআর-কাবিটা কর্মসূচির বিশেষ বরাদ্দে এগুলো নির্মিত হয়েছে। এই ঘরগুলো নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৭১ লাখ ৯৬ হাজার ৬৪০ টাকা।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গৃহীত উন্নয়ন সহায়তা শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে রবিদাস সম্প্রদায়ের ১০টি পরিবারকে পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের অর্থায়নে পাঁচটি অসচ্ছল চা-শ্রমিক পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক সুবিধাসহ প্রতিটি ঘরে রয়েছে দুটি কক্ষ। ঘরের সঙ্গে আছে বারান্দা, রান্নাঘর, গোসলখানা ও শৌচাগার।

চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মডেল আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ঘরগুলো নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২০ লাখ ৩ হাজার টাকা। উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর কাজগুলো বাস্তবায়ন করেছে। কাজ শেষ হওয়ায় গত জুন মাসে উপকারভোগীদের কাছে গৃহগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে।

দক্ষিণ শাহবাজপুরের দরিদ্র উপকারভোগী আবদুল জলিল বলেন, ‘ঘর পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে। স্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু। অনেক কষ্টের জীবন আমার। একটি পাকা ঘর পেয়ে আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই খুশি।’

বড়লেখা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. উবায়েদ উল্লাহ খান বলেন, ‘বড়লেখা উপজেলা একটি দুর্গম পাহাড়-টিলাবেষ্টিত এলাকা। এখানে প্রকৃত উপকারভোগী বাছাই এবং ঘর নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। নির্মিত ঘরগুলো গত ৩০ জুনের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। যাঁরা ঘর পেয়েছেন, তাঁদের মুখের হাসি আমাদের কাজে প্রেরণা জোগাচ্ছে।’

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামীম আল ইমরান বলেন, নির্দিষ্ট নকশা অনুযায়ী ভালো মানের উপাদান দিয়ে ঘরগুলো করা হয়েছে। যাঁরা ঘর পেয়েছেন, তাঁরা খুবই দরিদ্র। একটি ভালো ঘর নির্মাণ তাঁদের কাছে স্বপ্নের মতো। পাকা ঘর পেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো খুব খুশি। ইউএনও বলেন, ‘দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর একটা মানুষও গৃহহীন থাকবে না কর্মসূচি বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। স্থানীয় সাংসদ ও পরিবেশমন্ত্রীর নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে।’