নেই শুধু রোকেয়ার স্মৃতি

রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র বেহাল। তাঁর পৈতৃক ভিটার ভগ্নাবশেষও বিলীন হওয়ার পথে। সংরক্ষণের দায়িত্ব কার, কেউ জানে না।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পৈতৃক ভিটায় একটি ভাঙা দেয়ালে দুটি জানালার আকৃতি কোনো রকমে টিকে আছে এখনো। দর্শনার্থীরা তা-ই দেখছেন। গতকাল দুপুরে রংপুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ্দ মুরাদপুরে
ছবি: মঈনুল ইসলাম

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটির ভবন নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় চার কোটি টাকা। শুরু থেকেই সংগ্রহশালার ধূলিমলিন কাচের আলমারিগুলোতে কখনোই কোনো স্মারক রাখা হয়নি। পাঠাগারে প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া একটি রোকেয়া রচনাবলীর দেখা মিলল। গবেষণাকক্ষটি বেহাল, প্রায় দুই যুগে কোনো গবেষণাই আলোর মুখ দেখেনি।

গত ২৩ নভেম্বর স্মৃতিকেন্দ্রে গিয়ে আরও দেখা গেল, মিলনায়তনের ছাদ ভাঙা। সেখান দিয়ে পাখি ঢোকে, দর্শকের চেয়ারে পাখির মল। মঞ্চের গদিওয়ালা চেয়ারগুলো নানা জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। প্রশিক্ষণকক্ষে দেখা গেল, ২৫টি সেলাই মেশিনের ঢাকনা বন্ধ থাকতে থাকতে সেগুলো নষ্ট হওয়ার পথে।

অথচ কেন্দ্রের সবুজ মাঠে রোকেয়ার পিতলের ভাস্কর্যটি জানান দিচ্ছে, ২০০১ সালে স্মৃতিকেন্দ্রটি যাত্রা শুরু করেছিল রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবন ও কর্মকে সবার কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে। কথা ছিল, তাঁর কাজ নিয়ে গবেষণা, তাঁর লেখা গ্রন্থের অনুবাদ, প্রচার, প্রকাশনা হবে।

রংপুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ্দ মুরাদপুরে অবস্থিত রোকেয়া কমপ্লেক্সের একটি অংশে স্মৃতিকেন্দ্র। আরেকটি অংশে আছে রোকেয়ার পৈতৃক ভিটা।
কেন্দ্রটির যে লক্ষ্য–উদ্দেশ্য ছিল, তাতে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তবে এটি সচল করতে এখন বাংলা একাডেমি চেষ্টা করছে।
আবদুল্যাহ আল-ফারুক, রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উপপরিচালক

রংপুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ্দ মুরাদপুরে অবস্থিত রোকেয়া কমপ্লেক্সের একটি অংশ এই স্মৃতিকেন্দ্র। আরেকটি অংশে আছে রোকেয়ার পৈতৃক ভিটা। ২০০১ সালের ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ দশমিক ১৫ একর জমির ওপর বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। তারপর কেন্দ্রটি বেশ কয়েকবার বাংলা একাডেমি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) কাছে হাতবদল হয়েছে।

বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে স্মৃতিকেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে ২০১৭ সাল থেকে। একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বললেন, বাংলা একাডেমির অধীনে আসার পরও তেমন বড় কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কেন্দ্রটির কার্যকারিতা তেমন নেই। কেন্দ্র নিয়ে পরিকল্পনা নেই বলে অর্থ বরাদ্দও নেই।

বেগম রোকেয়া

২০০৪ সাল থেকে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উপপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন একাডেমির উপপরিচালক আবদুল্যাহ আল-ফারুক। কেন্দ্রে কাজ নেই বলে এক মাস ধরে ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে অফিস করছেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রটির যে লক্ষ্য–উদ্দেশ্য ছিল, তাতে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তবে এটি সচল করতে এখন বাংলা একাডেমি চেষ্টা করছে।

কিন্তু স্মৃতিকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে ভুতুড়ে পরিবেশ। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কেন্দ্রে গান ও ছবি আঁকার কার্যক্রমেও ভাটা পড়েছে। গ্রন্থাগারিক, দারোয়ান-পিয়ন দিয়ে কেন্দ্র চলছে কোনোরকমে। হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, তিনি কেন্দ্রটি নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি।

রোকেয়ার নামাঙ্কিত স্কুল-কলেজের নামফলক ছাড়া পায়রাবন্দ থেকে রোকেয়া বলতে গেলে হারিয়ে গেছেন।
রাজু আহমেদ, সভাপতি, রোকেয়া স্মৃতি সংসদ

১৯৮৫ সাল থেকে রোকেয়ার পৈতৃক ভিটার বেষ্টনীফটকের পাশেই বেসরকারি উদ্যোগে রোকেয়া স্মৃতি সংসদ পাঠাগারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের দাদি ছিলেন রোকেয়ার আত্মীয়। রফিকুল বলেন, রোকেয়াকে নিয়ে কোনো গবেষণাই হয়নি। রোকেয়া কীভাবে রোকেয়া হলেন, সেই পেছনের গল্পগুলো অজানা। তাঁকে পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের। কেন্দ্রটিই অচল হয়ে আছে শুরু থেকে।

সরেজমিনে রোকেয়ার পৈতৃক ভিটা

রোকেয়ার বাবা ছিলেন জমিদার। জমিদারবাড়ির অনেক সম্পত্তি এখন বেদখল হয়ে গেছে। রোকেয়ার পৈতৃক ভিটায় গিয়ে দেখা গেল, একটি ভাঙা দেয়ালে দুটি জানালার আকৃতি আর একটি দেয়ালের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে আছে। আর আছে গাছপালার মাঝে মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া কিছু ইট।

জেলা পরিষদ রোকেয়ার এই জন্মস্থানে প্রাচীর তৈরি করে দিয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের তালিকায় রোকেয়ার বাড়ি ও বাড়িসংলগ্ন মসজিদ রয়েছে। বাড়ির ফটকের পাশে লেখা আছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আদেশ—‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তির কোনো কিছু বিনষ্ট করলে পুরাকীর্তি আইনের অধীনে সর্বাধিক এক বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।’

কিন্তু বর্তমানে এই ভিটা সংরক্ষণের দায়িত্ব কার, তা কেউ জানে না। রংপুরের জেলা প্রশাসক মো. আসিব আহসান বলেন, রোকেয়া কমপ্লেক্স ভবন সংস্কার ও আধুনিকায়নের প্রস্তাব সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা আছে।

রোকেয়ার বাবার কবর আর বাড়ির পাশের মসজিদ ধ্বংস হতে হতে এগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, এখন তো রোকেয়ার বাড়ির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বাড়ির কাঠামো দেখে রেপ্লিকা তৈরি করতে পারে সরকার।

আর এই সংসদের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি রাজু আহমেদ বলেন, রোকেয়ার নামাঙ্কিত স্কুল-কলেজের নামফলক ছাড়া পায়রাবন্দ থেকে রোকেয়া বলতে গেলে হারিয়ে গেছেন।

রোকেয়ার উত্তরসূরিদের কথা

রোকেয়ার দ্বিতীয় ভাইয়ের পৌত্রী অধ্যাপক মাজেদা সাবের রোকেয়ার উত্তরসূরি বইটি লিখেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। বাসায় তিনি রোকেয়ার তসবি, পানের বাটাসহ বিভিন্ন জিনিস সংরক্ষণ করে রেখেছেন। হারানোর ভয়ে স্মারকগুলো স্মৃতিকেন্দ্রে দিতে সাহস পান না। এর আগে জাতীয় জাদুঘরে রোকেয়ার কিছু স্মারক দিয়েছিলেন, সেগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিকভাবে রোকেয়াসংক্রান্ত তথ্যগুলো সংরক্ষণে তেমন নজর দেওয়া হয়নি।

রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিকভাবে রোকেয়াসংক্রান্ত তথ্যগুলো সংরক্ষণে তেমন নজর দেওয়া হয়নি।
অধ্যাপক মাজেদা সাবের, রোকেয়ার দ্বিতীয় ভাইয়ের পৌত্রী

রোকেয়ার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মেয়ে রণজিনা সাবের পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষিকা। রোকেয়ার পৈতৃক ভিটার কাছাকাছি বাড়ি করেছেন। তাঁর বাড়িতে রোকেয়ার বাবার কোরআন শরিফ, লবণদানিসহ বেশ কিছু জিনিস সংরক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কাছে তিনি রোকেয়ার কিছু স্মারক হস্তান্তর করেছিলেন।

রণজিনা সাবের বলেন, ‘৯ ডিসেম্বর (রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিন) এলে রোকেয়া জীবিত হন। ডিসি, এমপিসহ সবাই পায়রাবন্দে আসেন ফুল দিতে। তারপর রোকেয়া আবার মরে যান। কলকাতা থেকে রোকেয়ার কবর পায়রাবন্দে স্থানান্তরের দাবি প্রক্রিয়াধীন, তা শুনেই যাচ্ছি।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রংপুরে প্রথম আলোনিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক)