নেতা হত্যার বিচার চাইতে ১৯ বছর পর রাজপথে আ.লীগ

আওয়ামী লীগ নেতা হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেনের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীদের মিছিল। রোববার শরীয়তপুর জেলা শহরে।প্রথম আলো

শরীয়তপুরে আওয়ামী লীগ নেতা হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেন হত্যা মামলার আসামিদের শাস্তির দাবিতে শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরা। সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতারা ওই হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্তদের বিচার দাবি করেছেন।
২০০১ সালের ৫ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয় জেলা জজ আদালতের সাবেক পিপি হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেনকে। দীর্ঘ ১৯ বছর যাবৎ আটকে আছে আলোচিত ওই হত্যা মামলার বিচারকাজ। এই ১৯ বছরে এর আগে শরীয়তপুরের আওয়ামী লীগকে বিচারের দাবিতে প্রকাশ্যে রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি।

নিহত হওয়ার সময় হাবীবুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। আর তাঁর ভাই মনির হোসেন ছিলেন পৌরসভা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ প্রয়াত হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ছিল।
আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে থেকে মিছিলটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় পর্যন্ত যায়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন শরীয়তপুর-১ আসনের সাংসদ ইকবাল হোসেন অপু। এরপর সেখানে সমাবেশ করা হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা প্রমুখ।
হত্যা মামলাটি নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর ‘১৯ বছর আটকে আছে বিচারকাজ, শঙ্কায় পরিবার’ শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। গত বৃহস্পতিবার ওই হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন আদালত। মামলার স্বাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হলে হাবীবুর রহমানের ছেলে পারভেজ রহমানের নিরাপত্তার জন্য তাঁর বাসভবন ও কার্যালয়ে সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

হাবীবুর রহমান
ছবি সংগৃহীত

হাবীবুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা জানান, হত্যা মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে কখনো হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া দূরের কথা, প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি। এমনকি হাবীবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পর্যন্ত দলীয় কার্যালয়ে হতো না। বিভিন্ন সময় হত্যা মামলার আসামিরা আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশ্রয়ে থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। ২০১৯ সালে শরীয়তপুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের কমিটিতে ওই মামলার আসামি ডাবলু তালুকদার ও বাবুল ফকিরকে সদস্য পদ দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হাবীবুর রহমান হত্যা মামলার কোনো আসামি কমিটিতে আছে কি না, তা জানা নেই। যদি থাকে তা হলে তাদের বহিষ্কার করা হবে। আর আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে।

মামলার এজাহার ও বাদীর পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর–১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন জাজিরা উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ। তখন আওরঙ্গর পক্ষে অবস্থান নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ। এ নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষ হতো। ওই নির্বাচনে জাজিরার কয়েকটি ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত হয়। ৮ অক্টোবর সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের বিষয় নিয়ে ৫ অক্টোবর হাবীবুরের শহরের বাসভবনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সভা চলছিল। ওই সভায় হামলা চালায় আওরঙ্গ সমর্থক সাবেক যুবলীগ নেতা সরোয়ার হোসেন বাবুল তালুকদারের লোকজন। সেখানে তাঁর ভাই মন্টু তালুকদার গুলিবিদ্ধ হন। এর কিছু সময় পরে ওই বাসভবনে পুনরায় হামলা করা হয়। তখন হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেন মারা যান।

আমার বাবা-চাচা আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য প্রাণ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়, কিন্তু তাদের হত্যার বিচার হচ্ছে না এটা আমাদের খুব পীড়া দিত। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাই।
পারভেজ রহমান, হাবীবুর রহমানের ছেলে

ওই ঘটনায় হাবীবুর রহমানের স্ত্রী জিন্নাত রহমান বাদী হয়ে আওরঙ্গকে প্রধান করে ৫৫ ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ তদন্ত করে ওই মামলা থেকে আওরঙ্গর নাম বাদ দিয়ে ২০০৩ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দায়ের করেন। মামলার বাদী তখন আদালতে নারাজি দেন। আদালত ওই নারাজির আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর বাদী জিন্নাত হাবীব উচ্চ আদালতে রিট করেন। তৎকালীন সাংসদ আওরঙ্গর প্রভাবে ওই রিট আবেদন দীর্ঘায়িত হয়। ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আওরঙ্গর মৃত্যু হয়। এরপর ওই বছরই উচ্চ আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দেন পুলিশকে। পুলিশ ওই বছর অক্টোবর মাসে আদালতে ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

আওরঙ্গ ছাড়াও ওই মামলার আসামি স্বপন কোতোয়াল, শাহজাহান মাঝি মৃত্যুবরণ করেন। আর চারজন চলে গেছেন দেশের বাইরে। বাকি আসামিরা জামিনে রয়েছেন। অধিকাংশ আসামি এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত রয়েছেন।
হাবীবুর রহমানের ছেলে পারভেজ রহমান বলেন, ‘আমার বাবা-চাচা আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য প্রাণ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়, কিন্তু তাদের হত্যার বিচার হচ্ছে না এটা আমাদের খুব পীড়া দিত। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাই। এখন মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ চলছে, দলীয় নেতারাও পাশে আছেন। আসামিপক্ষ আমাদের অনেক হুমকি ও প্রলোভন দিচ্ছে। কিন্তু আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও বাবা-চাচার হত্যার বিচার চাই।’