নোয়াখালীতে ডায়রিয়ায় দুই মাসে ১৪ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৪ হাজার ৭৭১

নোয়াখালীতে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালের বেডে জায়গা না হওয়ায় ঠাঁই হয়েছে করিডোরের মেঝেতে। সম্প্রতি নোয়াখালীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডেপ্রথম আলো

নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এপ্রিল ও মে—এই দুই মাসে জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ৭৭১ জন। ইতিমধ্যে ১৪ জন মারাও গেছে। এর মধ্যে আটজন মারা গেছে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে কিংবা আসার পথে। আর বাকিরা মারা গেছে বাড়িতে। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ডায়রিয়ায় মৃত্যুর কোনো রেকর্ড নেই। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় ও জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও হাতিয়ায়। এ ছাড়া সোনাইমুড়ীতেও আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। সুবর্ণচর উপজেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে একই পরিবারের দুজনের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার চর ওয়াপদা ইউনিয়নের চর বৈশাখী গ্রামে গত ২৪ মে মারা যান দাদি ছকিনা খাতুন (৯০)। আর এক সপ্তাহ পর গত ৩১ মে মারা যান নাতি মো. রাশেদ (২৬)। দুজনই ডায়রিয়া দেখা দেওয়ার অল্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মারা গেছেন বলে স্বজনেরা জানিয়েছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও হাতিয়ায়।

ছকিনা খাতুনের ছেলে নুরুল হক ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ডায়রিয়ায় দুজন মারা যাওয়া ছাড়াও তাঁদের পরিবারে এই রোগে আরও চারজন আক্রান্ত হয়েছেন। পরে তাঁদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। তিনি আরও বলেন, তাঁরা নলকূপের পানি পান করেন। তবে ঠিকমতো পানি ওঠে না। আর পুকুরের তলায় থাকা সামান্য পানি থালা-বাসন ধোয়া, গোসলসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শায়লা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, সুবর্ণচরে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না। অনেকে পুকুরের পানি পান ও ব্যবহার করেন। আবার দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় পুকুরের পানিও দূষিত হয়ে গেছে। সেই পানি ব্যবহার করছে মানুষ। ফলে এপ্রিল-মে মাসে উপজেলায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে গেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে।

শায়লা সুলতানা জানান, মে মাসে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ৫৭৯ জন রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে কোনো মৃত্যুর ঘটনা নেই। ৩১ মে পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ৬০ জন। এর মধ্যে ৩৯ জনই ডায়রিয়ার রোগী, যার মধ্যে ৩১ মে ভর্তি হয়েছে ১৪ জন। আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতাল থেকে কলেরা স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠছে।

ডায়রিয়া আক্রান্ত নয় মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা। সম্প্রতি নোয়াখালীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে
প্রথম আলো

সরেজমিনে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে দেখা যায়, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শিশু ও বয়স্ক ডায়রিয়ার রোগীর ভিড় বেশি। শিশুরোগের চিকিৎসক মো. সোহেল সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত বছরের এই সময় এমনিতে শিশুরদের মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সে হিসাবে অন্যান্য বছরের মতোই এবার আক্রান্তের হার। তবে এবার ব্যতিক্রম হলো বয়স্ক ব্যক্তিদের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলে বোঝা যেত, কারণ কী।

২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক শায়লা শাহরিয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, গত এপ্রিল মাসে ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হয়েছে ৭২০ জন। আর মে মাসে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ১৫০ জন। দুই মাসে মারা গেছে আটজন। তাদের মধ্যে চারজনকে হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেছেন। মারা যাওয়া আটজনের মধ্যে এপ্রিল মাসে মারা গেছে তিনজন, আর মে মাসে মারা গেছে পাঁচজন।

সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসে ডায়রিয়ায় ছয়জন মারা গেছে। এর মধ্যে সুবর্ণচরে তিনজন, হাতিয়ায় দুজন ও কবিরহাট উপজেলায় একজন। গত ২ মাসে ৯ উপজেলার মধ্যে সুবর্ণচরে সবচেয়ে বেশি—৭৭৯ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জে আক্রান্ত হয়েছে ৬০৬ জন, সোনাইমুড়ীতে ৩৬২, হাতিয়ায় ৩৬১, কবিরহাটে ২৬৫, সেনবাগে ২১৮, সদরে ১৩৮, চাটখিলে ১১২ ও বেগমগঞ্জে ৮৩ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।

জেলা সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, প্রচণ্ড গরম ও দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকায় পুকুরের পানি দূষিত হয়ে গেছে। এসব পানি ব্যবহার করে অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। জেলার সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জে আক্রান্তের হার বেশি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর কার্যালয় থেকে সব উপজেলাতেই পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি বিতরণ করা হয়েছে।