নয়ন বন্ডের ০০৭ গ্রুপের সদস্যরা কোথায়?

সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড
ফাইল ছবি।

আসল নাম সাব্বির আহমেদ। পরিচিত ছিলেন নয়ন নামে। পরে নয়নের সঙ্গে ‘বন্ড’ শব্দ যুক্ত করেন তিনি। বরগুনা শহরে তাঁর ছিল বিরাট কিশোর গ্যাং। ফেসবুকে তাঁরা ছিলেন ০০৭ নামের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের সদস্য। তাঁরা এখন কোথায়?

নয়ন বন্ড ছিলেন রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি। ২০১৯ সালের ২৬ জুন রিফাত হত্যার পর দেশজুড়ে আলোচনায় আসে নয়ন বন্ড ও তাঁর ০০৭ গ্রুপের নাম। একই বছরের ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন নয়ন।

রিফাত হত্যা মামলায় পুলিশ যে অভিযোগপত্র দেয়, তাতে বলা হয়, নয়ন বন্ডের গড়ে তোলা ‘০০৭’ নামে মেসেঞ্জার গ্রুপে ১০৬ জন সদস্য ছিল। কিন্তু রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে এই বাহিনীর ২৩ জন আসামি হয়। তাদের মধ্যে ১৪ জন কিশোর। এরা স্কুলপড়ুয়া। বাহিনীটির দ্বিতীয় প্রধান ছিলেন নয়নের প্রধান সহযোগী ও রিফাত হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী। আর কিশোরদের সমন্বয় করত রিফাত ফরাজীর ছোট ভাই রিশান ফরাজী। রিশান ফরাজীও রিফাত হত্যা মামলার কিশোর আসামিদের মধ্যে ১ নম্বর। এই বাহিনীর বাকি সদস্যদের ব্যাপারে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য নেই।

নয়ন মারা যাওয়ার পর বরগুনায় কিশোর গ্যাং কালচার কিছুটা স্তিমিত হলেও ০০৭ বাহিনীর কিশোর ও তরুণ সদস্যরা এখনো সক্রিয়। মূলত শহরে এখন তিনটি গ্যাং রয়েছে।

বরগুনা শহরের বিভিন্ন সূত্র বলছে, নয়ন মারা যাওয়ার পর বরগুনায় কিশোর গ্যাং কালচার কিছুটা স্তিমিত হলেও ০০৭ বাহিনীর কিশোর ও তরুণ সদস্যরা এখনো সক্রিয়। নয়ন নিহত হওয়ার পর এ বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে টিম-৬০ নামে আরেকটি মেসেঞ্জার গ্রুপ তৈরি করে। এটির তথ্য জানাজানি হলে তারা গ্রুপ ভেঙে আওয়ামী লীগের এক নেতার পক্ষে ভিড়ে যায়।

একই সূত্রে জানা যায়, মূলত শহরে এখন তিনটি গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে শহরের আমতলাপাড়, ডিকেপি রোড, কলেজ রোড, কলেজ ক্যাম্পাস, সরকারি বালিকা বিদ্যালয় সড়ক এলাকায় নয়নের গড়া বাহিনীর সদস্যরা এখনো নানা অপকর্মে সক্রিয় রয়েছে। এদের পৃষ্ঠপোষক আওয়ামী লীগের এক নেতার ছেলে। শহরের পিটিআই, জিলা স্কুল, খাড়াকান্দা, শহীদ স্মৃতি সড়ক এলাকায় একটি কিশোর দলের নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা। এ ছাড়া শহরের চরকলোনি, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট ও মহিলা কলেজ এলাকায় আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন ছাত্রদলের সাবেক এক ক্যাডার। তবে তিনি এখন জেলা ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট।

জানতে চাইলে বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বরগুনায় নতুন যোগ দিয়েছি। তাই নয়ন বন্ডের সন্ত্রাসী দলের সদস্যদের সম্পর্কে জানি না। তবে শহরে এখন আর কোনো কিশোর সন্ত্রাসী দলের অস্তিত্ব নেই।’

নয়ন বন্ডের সন্ত্রাসী দলের সদস্যদের সম্পর্কে জানি না। তবে শহরে এখন আর কোনো কিশোর সন্ত্রাসী দলের অস্তিত্ব নেই।
কে এম তারিকুল ইসলাম, ওসি, বরগুনা সদর থানা
রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা হত্যাকাণ্ডের চিত্র
সংগৃহীত

নয়নের যেভাবে ‘বন্ড’ হয়ে ওঠা

হলিউডের অ্যাকশন থ্রিলার ঘরানার ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের চলচ্চিত্রগুলো এ দেশেও ভীষণ জনপ্রিয়। ‘বন্ড, জেমস বন্ড’ বলে নিজের পরিচয় দেওয়া ওই চলচ্চিত্রগুলোর প্রধান চরিত্রটির কাণ্ডকারখানা অতিমানবীয়। কোনো বাধাই তাকে রুখতে পারে না, নারী মহলেও সবাই তাকে চায়, তবে সে কোনো বাঁধনে জড়ায় না।

এলাকাবাসীর ধারণা, এ রকম কোনো মোহ থেকেই হয়তো নয়ন নিজের নামের সঙ্গে বন্ড শব্দ জুড়ে দেন। গড়ে তোলেন জেমস বন্ডের এজেন্ট নম্বর ‘০০৭’ নামে মেসেঞ্জার গ্রুপ। তবে পার্থক্যটা হচ্ছে চলচ্চিত্রে জেমস বন্ডের ভাবমূর্তি নায়কোচিত, আর নয়নকে সবাই চিনতেন প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সন্ত্রাসী হিসেবে। ‘০০৭’ গ্রুপের সদস্যরাও এলাকায় বখাটে হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ছিনতাই, মাদক সেবন, ব্যবসা, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, চোরাই মোটরসাইকেল ব্যবসাসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল গ্রুপটির নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

চলচ্চিত্রে জেমস বন্ডের ভাবমূর্তি নায়কোচিত, আর নয়নকে সবাই চিনতেন প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সন্ত্রাসী হিসেবে।

নয়নদের বাসা বরগুনা শহরের ডিকেপি সড়কে। বরগুনা সরকারি কলেজের পেছনে একটি আধা পাকা ঘরে মাকে নিয়ে থাকতেন নয়ন। বাবা আবু বক্কর সিদ্দিকী ছিলেন ব্যাংকার। তিনি কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর একমাত্র বড় ভাই সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। মূলত প্রবাসী ভাইয়ের আয়েই চলত সংসার।

গতকাল মঙ্গলবার রাতে নয়নদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, দরজা ভেতর থেকে আটকানো। তবে কয়েকবার ডাকাডাকি করেও ভেতর থেকে সাড়া মেলেনি।

আজ সকালে বাড়িটিতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। সাব্বিরের মায়ের মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হলেও ধরেননি। প্রতিবেশী এক ব্যক্তি বলেন, করোনা পরিস্থিতির আগে সাব্বিরের বড় ভাই সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছেন। করোনার কারণে তিনি আর যেতে পারেননি। এখন দেশেই আছেন।

২০১১ সালে বরগুনা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন নয়ন। এরপর শহরের আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি নিজেকে বরগুনা সরকারি কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র পরিচয় দিয়ে প্রতিদিন কলেজে যেতেন। তবে কলেজটির অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেন, নয়ন কখনো এই কলেজের ছাত্র ছিলেন না।

এলাকার লোকজন জানান, মাদক সেবনের টাকার জন্য কয়েক বছর আগে ছিঁচকে চুরি, মুঠোফোন ছিনতাই ও ছোটখাটো চাঁদাবাজি শুরু করেন নয়ন। এর পেছনে ছিলেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনীতিকের ছেলে। তাঁর সন্ত্রাসীপনায় অতিষ্ঠ হলেও তেমন কিছু করার ছিল না। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে আবার ফিরেছেন এলাকায়। পরে হেরোইন ব্যবসা ও সেবনের কারণে শহরের প্রভাবশালী এবং সন্ত্রাসী বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তবে তাঁর সব কর্মকাণ্ড ছিল সরকারি কলেজ আর ডিকেপি সড়ককেন্দ্রিক।

কোনো পদ-পদবি না থাকলেও নয়ন নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী বা নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন নয়ন। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এসব কারণে বরগুনা সরকারি কলেজের ক্যাম্পাসে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি দাপট ধরে রাখতে পেরেছিলেন

তবে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান বলেন, ‘ও (সাব্বির) কোনো দিনই ছাত্রলীগের রাজনীতি কিংবা কোনো কমিটিতে ছিল না। কেউ প্রমাণও দিতে পারবে না। এটা অপপ্রচার।

ও (সাব্বির) কোনো দিনই ছাত্রলীগের রাজনীতি কিংবা কোনো কমিটিতে ছিল না। কেউ প্রমাণও দিতে পারবে না। এটা অপপ্রচার।
জুবায়ের আদনান, সভাপতি, জেলা ছাত্রলীগ, বরগুনা

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নয়নের বিষয়ে পুলিশ কখনোই কঠোর ছিল না। কারণ, এলাকার প্রভাবশালী মহল তাঁর প্রশ্রয়দাতা। নয়নের সহযোগী দুই ভাই রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ভায়রার ছেলে। এসব প্রভাবে এলাকায় অপকর্ম চালালেও কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না।

তবে পুলিশের ভাষ্য, নয়নের বিরুদ্ধে কয়েক বছর আগে মাদক ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা হলেও জামিনে বের হয়ে যান। রিফাত হত্যাকাণ্ডের মাস দুয়েক আগেও আরেকটি মামলায় কারাগার থেকে জামিনে বের হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় মাদক, অস্ত্র, সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ নানা অপরাধে সাতটি মামলা ছিল।