পটুয়াখালীতে দুস্থদের ঘর নিয়ে নয়ছয়

উপজেলার কাঁকড়াবুনিয়া ইউপির দুই সদস্য গৃহহীনদের নাম ব্যবহার করে দুটি ঘর নিয়েছেন। একজন ওই ঘর ভাড়াও দিয়েছেন।

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার কাঁকড়াবুনিয়া ইউনিয়নের কিসমতপুর গ্রামের লক্ষ্মণ মিস্ত্রির বাঁশ দিয়ে তৈরি জরাজীর্ণ ঘর
প্রথম আলো

‘ঘর পায় হ্যারা, য্যাগো ঘরদুয়ার আছে। মোর ঘরদুয়ার নাই, বাঁশ-পলিথিন দিয়া থাহি। মেম্বার, চেয়ারম্যানসহ অনেকের ধারে গেছি, কিন্তু ঘর পাই নাই,’ আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার কাঁকড়াবুনিয়া ইউনিয়নের কিসমতপুর গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মণ মিস্ত্রি। বাঁশ ও পলিথিনে তৈরি ঝুপড়িতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন তিনি। বৃষ্টিতে পানি ঢুকে ওই ঘর কর্দমাক্ত হয়ে যায়। পাশেই ছোট্ট একটি চায়ের দোকান থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই জীবিকা চলে তাঁর।

লক্ষ্মণ মিস্ত্রি বলেন, সরকারি উদ্যোগে গৃহহীন পরিবারের জন্য ঘর তৈরি করে দেওয়ার খবর জানতে পেরে বেশ কয়েকবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে গেছেন। কিন্তু তাঁর ঘর জোটেনি। তাঁর অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জনপ্রতিনিধিরাই এসব ঘর নিজেদের করে নিয়েছেন।

ঘর বরাদ্দ না পাওয়া কয়েকজন গৃহহীন ব্যক্তির অভিযোগ, কাঁকড়াবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবদুল বারী সিকদার প্রভাব খাটিয়ে গৃহহীনদের নাম ব্যবহার করে নিজের জন্য ঘর নিয়েছেন। একই ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পান্না মিয়ার বিরুদ্ধে অনিয়ম করে ঘর নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

যাচাই-বাছাই করেই গৃহহীনদের মধ্যে দুর্যোগ–সহনীয় ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তালিকায় কোনো সচ্ছল ব্যক্তির নাম থাকার অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরোয়ার হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), মির্জাগঞ্জ

আবদুল বারীর তত্ত্বাবধানে থাকা দুর্যোগ–সহনীয় বাড়িটি বরগুনা-বাকেরগঞ্জ সড়কের পাশে কাঁকড়াবুনিয়া শিংবাড়ির বাজারের অদূরে। তাঁর নিজের ঘর থাকায় দুর্যোগ–সহনীয় ঘরটি ভাড়া দিয়েছেন পল্লী বিদ্যুতের এক ঠিকাদারের কাছে। গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, ঘরের সামনে পল্লী বিদ্যুতের গাড়ি ও মালামাল স্তূপ করে রাখা। সেখানকার কর্মীরাও জানান, ঘরটি আবদুল বারীর কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়েছে।

আরেক ইউপি সদস্য মো. পান্না মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতিবেশী এক দুস্থ নারীর নাম ব্যবহার করে ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি বসবাসও করছেন। যে নারীর নাম ব্যবহার করা হয়েছে, তাঁর নাম পারভীন আক্তার। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ত্রাণের তালিকায় পারভীন আক্তারের নাম যোগ করে দেওয়ায় তিনি পান্না মিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পান না।

মুঠোফোনে পান্না মিয়া বলেন, পারভীন আক্তার সম্পর্কে তাঁর ভাবি। ঘরটি মূলত তাঁরই। পারভীন আক্তার বাড়িতে না থাকায় তিনি বসবাস করছেন।

দুস্থদের জন্য বরাদ্দ করা দুর্যোগসহনীয় ঘর এখন কাঁকড়াবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল বারী সিকদারের দখলে
প্রথম আলো

ইউপি সদস্য মো. বারী সিকদার তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে বলেন, ‘ঘরটি আমার ভাইয়ের নামে বরাদ্দ হয়েছে। আমার ভাই অসচ্ছল ব্যক্তি।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) বিশেষ কর্মসূচির আওতায় গৃহহীনদের জন্য দুর্যোগ–সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণের জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৬টি বাসগৃহ বরাদ্দ দেয় সরকার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২টি ঘরের অনুকূলে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬৮২ টাকা। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ২ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩১ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৬টি ঘরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৬০ টাকা, যার প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬০ টাকা।

সদস্যদের বিষয়ে কাঁকড়াবুনিয়া ইউপির চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, চেয়ারম্যানরা গৃহহীনদের নামের তালিকা পাঠালেও যাচাই-বাছাই করেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। অনিয়ম হলে সেখানে হয়েছে।

পিআইও রফিকুল ইসলাম বলেন, গৃহহীনদের তালিকা তৈরি করেন ইউপি চেয়ারম্যানরা। যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, তার দায় চেয়ারম্যানদেরই নিতে হবে। ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে তালিকা যাচাই-বাছাই করে ৪৮টি ঘরের কাজ শেষ হয়েছে এবং গত ১৭ এপ্রিল ঘরগুলো সুবিধাভোগীদের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে।

জানতে চাইলে মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরোয়ার হোসেন বলেন, যাচাই-বাছাই করেই গৃহহীনদের মধ্যে দুর্যোগ–সহনীয় ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তালিকায় কোনো সচ্ছল ব্যক্তির নাম থাকার অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।