পদ্মায় কৌশলে ইলিশ শিকার

শিশু-কিশোরদের দিয়ে নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা হচ্ছে। অভিযানের ফাঁকে চলছে ইলিশ শিকার।

জেলেরা রয়েছেন ডাঙায়। শিশু-কিশোরেরা নৌকায় করে মাছ ধরছে। গত শুক্রবার দুপুরে গোয়ালন্দের দেবগ্রাম এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। ইলিশ শিকার বন্ধে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্ন কৌশলে পদ্মা নদীতে চলছে ইলিশ শিকার। রাজবাড়ীতে জেলেরা শিশু-কিশোরদের দিয়ে নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। অন্যদিকে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে প্রশাসনের অভিযানের ফাঁকে ফাঁকে ইলিশ শিকার করছেন জেলেরা।

গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রামের কাওয়ালজানি এলাকায় গত শুক্রবার গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে ফাঁকে ফাঁকে বসে আছেন জেলেরা। দূর থেকে নদীর দিকে খেয়াল রাখছেন তাঁরা। নদীতে নৌকায় জাল দিয়ে নামিয়েছেন তাঁদের পরিবারের শিশুদের।

নদীর পাড়ে বসা পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী জেলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ থেমে থেমে অভিযানে নামছে। নৌকায় মাছ

না পেলেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য নিজে না নেমে পোলাপান নামিয়ে দিয়েছি। ওদেরকে ধরলেও ছেড়ে দেবে।’

মাঝনদীতে একটি ডিঙি নৌকায় তিন কিশোরকে মাছ শিকার করতে দেখা যায়। নৌকাটি কিছুক্ষণের মধ্যে পাড়ে এসে ভেড়ে। তিনটি জাটকা পেয়েছে তারা।

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলছে ইলিশ শিকার। গত বৃহস্পতিবার রাতে চরভদ্রাসনের এমপি ডাঙ্গী ভাঙ্গার মাথায়।
ছবি: প্রথম আলো

বরাট অন্তারমোড়ে গাছতলায় বসে আছেন আকমত আলী সরদার। নৌকায় করে তাঁর নাতিরা মাছ ধরছেন। দূরের দুটি নৌকা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই নৌকায় আমার চারজন নাতি ও এক ভাতিজা আছে। আমরা বয়স্ক মানুষ। নৌকায় আমাদের দেখলে ধরে নিয়ে যাবে। তাই ওদের নামায়ছি। যদি সমস্যা দেখি তাহলে ফোন করে জানায় দিলে ওরা সরে যাবে।’

নিষেধাজ্ঞার সময় কেন মাছ শিকার করছেন, জানতে চাইলে আকমত আলী সরদার বলেন, ‘নদীতে তেমন মাছ নেই। উড়াকান্দা থেকে অন্তারমোড় পর্যন্ত দুইবার জাল ফেলে আইছে। দুইটা জাটকা ছাড়া কিছুই পাইনি। অভিযানকারী দল আমাদের দেখলে ধরে নিয়ে জাল পুড়িয়ে দিত। আর আমাদের দিত জেলে। বাড়িতে বসে আছি তাই, ফাঁকফোকর বুঝর একটু নামছি। এ ছাড়া করব কী?’

নিষেধাজ্ঞার শুরু (৪ অক্টোবর) থেকে গত শনিবার (১৬ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত গোয়ালন্দে ৩৩ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। জেলেদের কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায়, ২ লাখ ঘনমিটার জাল এবং ১১০ কেজি ইলিশ জব্দ করা হয়েছে।

গোয়ালন্দের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুদের জেল-জরিমানা করার সুযোগ নেই। যে কারণে অভিভাবকেরা কাজটি করছেন। মাঝে এক দিন একটি শিশুর বাবা ও বড় ভাইকে ধরে আনা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে শিশুদের অভিভাবকদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার।

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চরভদ্রাসন উপজেলার এমপি ডাঙ্গী ভাঙ্গার মাথা থেকে হরিরামপুরের নমুরছাম চরশালিপুর হয়ে সদরপুরের জল সীমানা এলাকায় অবাধে ধরা হচ্ছে মা ইলিশ। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে অন্তত অর্ধশত জেলে সেখানে মাছ শিকার করছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাত আটটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত জেলেরা মাছ ধরেন। নদীতে জাল ফেলে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পর জাল তোলার কাজ শুরু হয়। জাল তুলে মাছ সংগ্রহ করতে ২০ মিনিট সময় লাগে।

গত বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে গোপালপুর ফেরিঘাট থেকে সদরপুরের জলসীমার মধ্যে ৮-১০টি নৌকায় মাছ ধরা হচ্ছে। অনেককে প্রকাশ্যে আলো জ্বালিয়ে কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায়।

উপজেলার চর ঝাউকান্দা ইউনিয়নের মুন্সীর চর গ্রামের বাসিন্দা জেলে মাহিন মুন্সী (৬১) বলেন, নিষেধাজ্ঞা শুরুর দিন হতেই তাঁরা মাছ শিকার করছেন। এবার অভিযান কম। তাই মাছ শিকারে খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না।

সদর ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা এলাকার জেলে রাহাত হোসেন (৫৩) বলেন, শুধু মাথাভাঙ্গা এলাকার অন্তত ১৫ জন জেলে রাতে মাছ শিকার করেন। উপজেলার অন্তত অর্ধশত জেলে এ মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত।

উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত ১২ দিনে কোনো জেলেকে আটক করা হয়নি। তবে অভিযানে ১৮ কেজি ৩০০ গ্রাম ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই সময় ৭৩ হাজার মিটার বিভিন্ন প্রকার জাল ধ্বংস করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চরভদ্রাসন উপজেলা মৎস্য সমিতির এক নেতা বলেন, মৎস্য অফিসের অভিযানের খবর জেলেরা আগে থেকে জেনে যাচ্ছেন। যে কারণে অভিযানের সময় কোনো জেলে ধরা পড়ছেন না। ১২ দিনেও কেউ আটক হয়নি। আগে কখনো এমন হয়নি।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম মাহমুদুল হাসান বলেন, ইলিশ রক্ষায় মৎস্য বিভাগের ভূমিকা সন্তোষজনক। নদীতে এখন মাছ না থাকায় জেলেরা নদীতে কম নামছেন। এ কারণে তাঁরা যখন নদীতে অভিযানে যান, তখন জেলেদের পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বাজেটস্বল্পতার কারণে বেশি অভিযান পরিচালনা করাও সম্ভব হচ্ছে না।