পরিবারটি একঘরে দুই বছর ধরে

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের দলগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীখাতা বালাপাড়া গ্রামের জহুরুল ইসলাম ঝগড়ার সময় স্ত্রী মঞ্জিলা বেগমকে মৌখিকভাবে একাধিকবার তালাক দেন। এই তালাকের জের ধরে গ্রামটির সমাজপতিরা দুই বছর ধরে দরিদ্র পরিবারটিকে একঘরে করে রেখেছেন।

এ ঘটনায় পরিবারটির পক্ষ থেকে থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ বিষয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক সদস্য ও এক মাদ্রাসা সুপার সমাজপতিদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরও সমাজপতিরা তাঁদের কথা অমান্য করে পরিবারটিকে একঘরে করে রেখেছেন।

এ ব্যাপারে করিমপুর নেছারিয়া দ্বিমুখী মাদ্রাসার সুপার মো. আবু জাফর বলেন, ‘আমি ঘটনাটি শুনে ওই গ্রামে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। ধর্মীয় ও আইনি যে বিধান রয়েছে, সে অনুযায়ী জহুরুল ও মঞ্জিলার তালাক হয়নি। আমি বিষয়টি গ্রামের মসজিদে গিয়ে বলে এসেছি। এরপরও তাঁরা পরিবারটিকে একঘরে করে রাখার সিদ্ধান্তে অটল। আমার যা করার ক্ষমতা ছিল, তা করেছি। এখন আইনি ব্যবস্থা ছাড়া আর কী পথ খোলা আছে, আমার জানা নেই।’

গত রোববার শ্রীখাতা বালাপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের পাকা মসজিদটির একটু দূরেই জহুরুল ইসলামের বাড়ি। এ মসজিদ কমিটির সভাপতি ও দলগ্রাম ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য প্রভাবশালী নুরুল আমিন (৫৫)। এ সময় ওই পরিবার ও এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রভাবশালী নুরুল আমিনের নেতৃত্বে সমাজপতিরা ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে দরিদ্র জহুরুল ও মঞ্জিলা দম্পতিকে দুই বছর ধরে একঘরে করে রেখেছেন।

ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা গ্রামের কোনো দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য টাকা দিয়েও কিনতে পারেন না। তাঁদের বাড়িতে গ্রামের কেউ আসে না। তাঁরাও কারও বাড়িতে যেতে পারেন না। কেউ তাঁদের কোনো সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেন না। তাঁদের দাওয়াতেও গ্রামের কেউ আসে না। তাঁদের কাছ থেকে গ্রামের মসজিদের চাল বা টাকা নেওয়া হয় না। মহররম উপলক্ষে তাঁদের কাছ থেকে কোনো চাঁদা নেওয়া হয় না। একঘরে করে রাখার কারণে এই পরিবারের প্রধান জহুরুল বা পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য জুমার দিন বা অন্য কোনো দিন নামাজ পড়তে গ্রামের মসজিদে যেতে পারেন না।

মঞ্জিলা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী জহুরুল ঝগড়া করে রাগের মাথায় প্রায় দুই বছর আগে আমাকে দু–তিনবার মৌখিকভাবে তালাক শব্দটি উচ্চারণ করেন। ঘটনাটি শুনে গ্রামের মসজিদে জহুরুলকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সেখানে মৌখিকভাবে আমাকে তালাক দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে আমি লিখিতভাবে তালাকের কোনো কাগজ না পাওয়ায় তাঁর সঙ্গে সংসার করছি। কিন্তু গ্রামের মসজিদের সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল আমিন মসজিদে ঘোষণা করেন, আমাদের তালাক হয়ে গেছে। আমাদের সংসার অবৈধ, অসামাজিক। তাই আমাদের একঘরে করে রাখা হয়েছে।’

মঞ্জিলা আরও বলেন, ‘আমি সমাজপতিদের কাছে সমাধান চেয়েছি, সমাধান হয়নি। গ্রামে আমরা কারও কাছে বিচার না পেয়ে থানায় অভিযোগ দিলাম, তাতেও কিছু হলো না। এখন আপনারা (সাংবাদিক) আসলেন, এখন যদি সমাধান হয়, দোষীরা সাজা পায়।’

পরিবারটিকে একঘরে করে রাখার কথা স্বীকার করে নুরুল আমিন বলেন, ‘তালাক হওয়া স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করায় ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে গ্রামের ১০ জন মিলে ওই পরিবারকে একঘরে করে রাখার সিদ্ধান্ত নিই। এখন তাঁরা তাঁদের মতো থাকবে, আমরা আমাদের মতো আছি।’

একঘরে করা বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এমন প্রশ্নের জবাবে নুরুল আমিন বলেন, ‘সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে সবাই মিলে এ সিদ্ধান্ত নিই। এখন তাঁরা সমাজের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে, সমাজ ভেবে দেখবে তাঁদের জন্য কী করা যায়।’

শ্রীখাতা বালাপাড়া গ্রামের জামে মসজিদের ইমাম আয়ুব আলী বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ধর্মীয়ভাবে জহুরুল ও মঞ্জিলার তালাক সঠিক হয়নি। কিন্তু আমি যদি মসজিদ কমিটির কথা না শুনি, তবে তারা আমাকে বাদ দিয়ে অন্য ইমাম নিয়োগ দিবে। এ কারণেই ওই পরিবার আমাকে তাঁদের বাড়িতে দাওয়াত দিলেও আমি যাই না।’

দলগ্রাম ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘আমি দুই বছর ধরে চেষ্টা করেও একঘরে হয়ে থাকা ওই পরিবারের সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। বিষয়টি দেখতে কালীগঞ্জের করিমপুর নেছারিয়া দ্বিমুখী মাদ্রাসার সুপারকেও বলেছি।’

দলগ্রাম ইউপির চেয়ারম্যান শফিকুল আলম বলেন, ‘আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে ঘটনাটি জানলাম। যাঁরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

জানতে চাইলে কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরজু মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘এ ঘটনায় অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত করে দেখছি। পাশাপাশি উভয় পক্ষকে সামাজিকভাবে ঘটনাটি মীমাংসা করে নিতে বলেছি। আমাদের যতটুকু করার সুযোগ রয়েছে, সেটুকু করা হবে।’