পর্যটকশূন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে সুনসান নীরবতা

ঈদের সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে ভিড় জমান পর্যটকেরা। তবে করোনার কারণে এবার ঈদে দেখা নেই পর্যটকের। ছবি: প্রথম আলো
ঈদের সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে ভিড় জমান পর্যটকেরা। তবে করোনার কারণে এবার ঈদে দেখা নেই পর্যটকের। ছবি: প্রথম আলো

হাওরে বিশাল জলরাশি। কখনো ঢেউয়ে উথাল-পাতাল, আবার কখনো মৃদুমন্দ বাতাসে জলের ওপর মিষ্টি রোদের খেলা। সারি সারি হিজল-করচগাছ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখানে-ওখানে। গাছে পাখির কলতান। নীল আকাশ ছায়া ফেলে জলের ওপর। উত্তরে তাকালেই হাতছানি দেয় মেঘালয় পাহাড়।

একসঙ্গে জল, জোছনা আর পাহাড়ের মেলবন্ধন চোখে পড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর তাই পর্যটকদের প্রিয় স্থান। কিন্তু চার মাস ধরে হাওরে পর্যটক নেই। হাওরজুড়ে এখন সুনসান নীরবতা। হাওরে জলের খেলা, গাছ-পাখি আর মাছের মেলা দেখার যেন কেউ নেই।

করোনাকাল সবকিছু বদলে দিয়েছে। অথচ বছরের এ সময়টায় হাওরে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। ঈদের ছুটির দিনগুলোয় বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পর্যটকে দিনে-রাতে মুখর থাকে টাঙ্গুয়ার হাওর, হাওরপাড়ের শহীদ সিরাজ লেক, লেকের পাড়ে সবুজে মোড়া ছোট ছোট টিলা, টেকেরঘাট, বারেক টিলা, জাদুকাটা নদী, শিমুলবাগান। হাওরে নৌকায় রাতযাপন আর গানবাজনার সঙ্গে জোছনা উপভোগ ভ্রমণে নতুন মাত্রা জোগায়। বছরজুড়ে এখানে পর্যটক আসা-যাওয়া থাকলেও বর্ষায় আসেন বেশি। এতে নানাভাবে উপকৃত হন এলাকায় হাজারো মানুষ। বাজারের মুদি দোকানি থেকে শুরু করে নৌকা ও স্পিডবোটের মালিক, মাঝি, শিল্পী, পাচক; লেগুনা, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের চালক, গেস্টহাউসের মালিক—আরও কত রকমের লোকজন। এলাকায় অন্তত তিন হাজার পরিবার হাওরকেন্দ্রিক এই পর্যটন থেকে বছরজুড়ের নানাভাবে উপকৃত হয়। কিন্তু এখন এসব পরিবারের মানুষ কষ্টে আছে। অনেকেই কর্মহীন, কারও নৌযান পড়ে আছে দিনের পর দিন, গেস্টহাউসে তালা ঝুলছে।

পবিত্র ঈদুল আজহা নিয়ে একটা আশা ছিল তাদের মনে। কিন্তু সেই আশা নিরাশায় পরিণত হয় যখন প্রশাসন থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় হাওরে পর্যটকদের ভ্রমণে পুরোনো নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত ১৯ মার্চ থেকে হাওরে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে জেলা প্রশাসন। তবে এ নিয়ে এত দিন তেমন একটা আলোচনা ছিল না। যে কারণে এবারের ঈদের আগে-পরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাওরে আসতে কিছু পর্যটক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এ জন্য হাওরে নৌযান ভাড়াসহ নানাভাবে তাঁরা যোগাযোগ করেন। কিন্তু একসময় সব প্রস্তুতি বাতিল করতে হয়েছে।

টাঙ্গুয়ার হাওরের গোলাবাড়ি এলাকায় চার বছর আগে টিনশেডের পাকা চার কক্ষের একটি ঘর বানিয়েছেন মো. খসরুল আলম। ঘরের সামনে বাগান করেছেন। আলাদা করে পর্যটকদের বসার ব্যবস্থা আছে একপাশে। যেখানে বসলে হাওরের দখিন হাওয়ার পরশ মেলে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। ঘরটির নাম ‘হাওর বিলাস’। হাওরে পর্যটকদের যাওয়া-আসা এবং ঘুরের বেড়ানোর জন্য তাঁর তিনটি নৌকাও রয়েছে। দিনে দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকার পর্যটকদের সঙ্গে তাঁর একটা যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। এসবের আয় দিয়েই সংসার চলে। নিজের তেমন কোনো জমিজিরাত নেই। এই ‘হাওর বিলাস’–এর ওপরই তাঁর ভরসা। খসরুল আলম বলেন, ‘হাওরে সারা বছরই লোকজন আসে। কিন্তু বর্ষায় পর্যটক আসে বেশি। কিন্তু এবার তো মৌসুম চলে যাচ্ছে। হাওরে কেউ আসছে না। ঈদে ভাবছিলাম খুলব। কিন্তু হয়নি। আমাদের এখন পথে বসার অবস্থা। ধারদেনা করে চলছি।’

তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা তেপান্তর ইজি ট্যুরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবরুল হাসান জানান, এই হাওরে পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানো ও রাতযাপনের জন্য ৬০ থেকে ৭০টি নৌকা, ১৫ থেকে ২০ স্পিডবোট রয়েছে। এসব নৌকা তৈরিতে ৫ লাখ থেকে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে। পর্যটকদের জন্য আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রেখেই এগুলো তৈরি করা হয়েছে। এসব নৌকা লোকজন হাওরে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি দল বেঁধে রাত্রিযাপন করেন। ভরা মৌসুমে একেকটি নৌকা প্রতিদিন ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা ভাড়া যায়। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে পর্যটক না আসায় এসব নৌকার মালিক ও মাঝিরা বেকার সময় কাটাচ্ছেন। আবার হাওরপাড়ের সীমান্তবর্তী অন্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পর্যটকদের মোটরসাইকেল ভাড়া নিতে হয়। এ জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরের উত্তরপাড়ের পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য ৬০০ মোটরসাইকেল রয়েছে। একেকটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে একেকটি পরিবার জড়িত। কিন্তু এসবের চালকেরাও এখন কর্মহীন। অসহায়ভাবে জীবন যাপন করছেন তাঁরা।

ঈদের সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে ভিড় জমান পর্যটকেরা। তবে করোনার কারণে এবার ঈদে দেখা নেই পর্যটকের। ছবি: প্রথম আলো
ঈদের সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে ভিড় জমান পর্যটকেরা। তবে করোনার কারণে এবার ঈদে দেখা নেই পর্যটকের। ছবি: প্রথম আলো

বাবরুল হাসান বলেন, সবকিছুই তো সীমিত পরিসরে চলছে। এখানেও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে সীমিত পরিসরে হলেও পর্যটকেরা আসতে পারেন, সেই সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এতে হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত লোকজন যে কষ্টে আছে, সেটি কিছুটা হলেও কমবে।

হাওরপাড়ের টেকেরঘাট এলাকার স্বাধীন বাংলা মোটরসাইকেল চালক সমিতির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, করোনো শুরু পর থেকে চালকেরা বেকার। একেকটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে একেকটি পরিবার যুক্ত। এমন দিনে তাঁরা মহাব্যস্ত থাকেন। দিনে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় করতে পারতেন একেকজন মোটরসাইকেলচালক। কিন্তু এখন খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে তাঁদের। আমিনুল আলম নামের এক মোটরসাইকেলচালক বলেন, ঈদের পর পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাওরে আসতে আগ্রহী পর্যটকদের জন্য তিনি ১৪টি নৌকা বুকিং দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে যখন জানতে পারেন পর্যটকদের আসতে দেওয়া হবে না, তখন সব বাতিল করেছেন।

সুনামগঞ্জ শহরের নাট্যকর্মী মেহেদী হাসান বলেন, তাঁরা দলবলসহ ৫ আগস্ট হাওর ভ্রমণে যেতে চেয়েছিলেন। এ জন্য নৌকা রিজার্ভ, সেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখন জেনেছেন, হাওরে যেতে দেওয়া হবে না। তাই সব বাতিল করছেন। জেলার শহরের রায়পাড়া এলাকার বাসিন্দা অমিত রায়ের তিনটি নৌকা রয়েছে। এসব নৌকা সুনামগঞ্জ শহর থেকে পর্যটকদের টাঙ্গুয়ার হাওরে নিয়ে যায়। ২ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত তাঁর তিনটি নৌকাই বুকিং ছিল। কিন্তু একই কারণে সব বুকিং বাতিল করতে হয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণাসিন্ধু চৌধুরী বলেছেন, ‘প্রতিবছর লাখ খানেক পর্যটক আসেন টাঙ্গুয়ার হাওর ও এর আশপাশের এলাকায়। এতে আমাদের এলাকার লোকজনও নানাভাবে লাভবান হন। পর্যটক না আসায় এই লোকজন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, এটা ঠিক। কিন্তু করোনার এই মহামারির সময়টায় হাওরে পর্যটকদের আসতে আমরা নিরুৎসাহিত করছি। এটা সবার ভালোর জন্যই। কারণ, অনেকেই জেলার বাইরে থেকে আসবেন। হাওরে ঘুরবেন। স্থানীয়দের সঙ্গে মিশবেন। তাই ঝুঁকি থেকেই যায়।’

জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত ১৯ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ দর্শনীয় স্থানগুলোয় পর্যটকদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। এটি এখনো বলবৎ। হাওরে পর্যটকেরা এলে দল বেঁধে নৌকায় ঘোরাঘুরি করেন। নৌকায় রাত যাপন করেন। এ ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকবে না। কারও জন্যই এটি ভালো হবে না। এতে যেকেউ কোভিডে সংক্রমিত হতে পারেন। তাই এখন হাওর এলাকায় পর্যটকদের না আসতে আমরা অনুরোধ করছি। পরিস্থিতির উন্নতি হলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।’