‘পাঁচ দিন পর আজ ঘরের ছাওয়ারা হাতের রান্না খাবে’

রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া বড়করিমপুর এলাকায় পাঁচ দিন পর পোড়াভিটায় রান্না উঠিয়েছেন নারীরা। ২২ অক্টোবর সকালে
প্রথম আলো

ভোরের মৃদু সূর্যালোক পড়ে সবুজ খেতের শিশিরবিন্দু চকচক করছে। আজ শুক্রবার ঘড়ির কাঁটা তখন ছয়টা ছুঁই ছুঁই। চারদিক শান্ত, কোলাহলমুক্ত। গ্রাম পুলিশ, পুলিশ ও বিজিবির দল শিশির মাড়িয়ে মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকায় টহলে ব্যস্ত। সময় বাড়তে না বাড়তেই কোলাহলে ভরে উঠতে শুরু করে পুরো এলাকা। পোড়া ঘরের ছাই-ময়লা সাফ করে কেউ বসিয়েছেন রান্না। কেউ বা ভাঙা বেড়া, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ঘর মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকায় গত রোববার রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে উত্তেজিত জনতার দেওয়া আগুনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২১টি ঘর পুড়ে যায়। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় অন্তত ৪০টি বাড়িতে। এ সময় বাড়ির লোকজন ধানখেতে ও আশপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে রক্ষা পান। পুলিশ উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ৬১টি রাবার বুলেট ও ১০টি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এরপর পুলিশের অভয়ে লুকিয়ে থাকা লোকজন ওই দিন ভোরে পোড়া ঘরে ফেরেন। ঘটনার দিন থেকে কোনো বাড়িতে চুলা জ্বলেনি। সরকারি উদ্যোগে সেখানে রান্না করা খাবার খাওয়ানো হচ্ছিল ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে। আজ শুক্রবার থেকে আবার সবাই বাড়িতে রান্না শুরু করেছেন।

সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মাঝিপাড়ার সীতা রানীর বাড়িতে দেখা যায়, পোড়া ঘরের পাশে চুলায় ভাত উঠিয়েছেন তিনি। মেয়ে সুমী রানী পাশে বসে মাকে তরকারি কাটতে সহায়তা করছেন। চুলায় খড় ঠেলে সীতা রানী বলতে থাকেন, ‘যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। দুটি ঘর, আসবাব সব পুড়ে গেছে। জ্বলে যাওয়া থালাবাসন ঘষেমেজে সহায়তা পাওয়া চাল, ডাল রান্না করছি। আজ পাঁচ দিন পর ঘরের ছাওয়ারা (ছেলেমেয়ে) হাতের রান্না খাবে।’

ঘটনার দিন থেকে কোনো বাড়িতে চুলা জ্বলেনি। সরকারি উদ্যোগে সেখানে রান্না করা খাবার খাওয়ানো হচ্ছিল ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে। আজ শুক্রবার থেকে আবার সবাই বাড়িতে রান্না শুরু করেছেন।

সীতা রানীর বাড়ির কিছু দূর পরেই পরেশ চন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা ঘর ঠিক করার জন্য বাঁশ কেটে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, ‘ওরা ঘরদোর ভাঙছে, লুট করছে। গ্রামোত আগুন দিছে। সরকার থাকি টিন পাছি, তাই দিয়া ঘর ঠিক করছি। থাকার জায়গা নাই। বৃষ্টি হয়। মাইনসের বাড়ি যায়া থাইকপার নাগে। খুব কষ্ট বাবু...। মাথার ওপরোত চালাটা তুলবার পারলে এইটেকোনায় থাকা যাইবে।’

পাশেই হরিদাস চন্দ্রের বাড়ি। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে চালে নতুন টিন লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কাজের ফাঁকে তাঁর স্ত্রী কনিকা রানী বলেন, জাল নেই। তাঁর স্বামী মাছ ধরতে যেতে পারছেন না। ভাঙাচোরা ঘরদোর নিয়ে খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে তাঁদের। বাঁচির নাগবে তো। ওই তকনেথাকার আশ্রয় ঠিক করুছি।

দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে গরু পুড়ে যাওয়ার কথা স্মরণ করে আহাজারি করছেন সুমতি রানী। গত মঙ্গলবার রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া বড়করিমপুর এলাকায়
প্রথম আলো

কথা বলে জানা গেল, গ্রামের প্রসন্ন রায়, মিনতি বালা, লক্ষ্মী রানী, স্বপ্না রানীসহ অনেকে ঘটনার পাঁচ দিন পর পোড়া ভিটায় আজই প্রথম চুলায় রান্না তুলেছেন। দীপিকার ছেলে সুমন রায় (৬) মায়ের রান্না করা দেখে বেজায় খুশি। বলে, ‘আইজ বেশি করি ভাত খাইম।’এ কথা শুনে মায়ের মলিন মুখ তৎক্ষণাৎ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

উত্তেজিত জনতার হামলায় সুমতি রানী তাঁর ঘর হারিয়েছেন। পুড়ে মরে গেছে তাঁর গাভি। তাঁর পোড়া ভিটায় সরকারিভাবে তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে ঘর। ঢাকা থেকে ছুটে এসেছেন ছেলে আনসার সদস্য কৃষ্ণ চন্দ্র (৩২)। কৃষ্ণ চন্দ্র বলেন, ‘আগের যা ছিল, তা কি আর ফেরত পাব? সব শেষ হয়ে গেছে। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। এখন আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। যুগ যুগ ধরে এখানে বসবাস করছি। কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়াবিবাদ হয়নি। আমরা আগের মতো সবার সঙ্গে মিলেঝিলে সুখে–শান্তিতে থাকতে চাই, চাই বাঁচতে।’