‘পাখিরা গ্রামের অতিথি, হামরা ওদের যত্ন করি’

বাঁশঝাড়ে অলস বসে আছে এক জোড়া বক। বগুড়ার কাহালু উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের গাছপালায় চোখে পড়ে নানা জাতের পাখিছবি: প্রথম আলো

পাখির প্রতি মিনা বসাকের মায়া তাঁর কথা বলার স্বরেও বোঝা যায়। নিজের পালন করা পাখি না, গ্রামের গাছপালায় বাসা বেঁধে থাকা নানা জাতের পাখি। কিন্তু সে পাখি সম্পর্কে বলতে গিয়েও মিনা বসাক টেনে আনলেন প্রায় দেড় যুগ আগের তাঁর বিয়ের সময়কালকে।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা মিনা বললেন, ‘আমার বিয়া হয়া আসাত থাকা দেখিচ্ছি। তা–ও মনে নাই। ক্যালেন্ডারত (বিয়ের তারিখ) লেখা আছে। হামার বেটা বিএ অনার্স পড়ে। পাখিগুলি বৈশাখ মাসের আগেই চলা আসে আর ভাদ্র মাসের শেষে চলা যায়।’

আলাপের সময় গ্রামের পাখিদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মিনা বোঝালেন, তাঁর বিয়ের সময় থেকে দেখে আসছেন, দুর্গাপুর গ্রামে বৈশাখ মাসে পাখি আসে, আবার ভাদ্র মাসে চলে যায়। তাঁর ছেলে বড় হয়েছেন, এখন স্নাতক পড়ছেন। কিন্তু গ্রামে পাখিদের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়নি।

বগুড়া জেলা শহর থেকে দুর্গাপুর হাটের দূরত্ব প্রায় ১৮ কিলোমিটার। বাজার থেকে সড়ক ধরে ৫০ গজ এগুলেই চোখ আটকাবে পথিকের। কানে আসবে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। বাঁশবাগানজুড়ে বক পাখির আবাসস্থল। বিভিন্ন গাছপালায় চোখে পড়ে শামুকখোল, ডাহুক, বক, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, ঘুঘু, শালিক ও পানকৌড়ি।

গ্রামে ঢুকে গৃহিণী মিনা বসাকের বাড়িতে দেখা যায়, বাঁশঝাড়ে বাসা বেঁধেছে বক, শামুকখোল ও পানকৌড়ি। মিনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আলাপের সময় বললেন, ‘পাখিরা গ্রামের অতিথি। কিন্তু বৃষ্টি নামলে গন্ধে থাকা যায় না। সেগলা হামরা মানাই নিছি। অভ্যাস হয়া গেছে। হামরা ওদের যত্ন করি। ওরা কারোরই ক্ষতি করে না।’

গত মঙ্গলবার বিকেলে দুর্গাপুর গ্রামে গিয়ে আরও আলাপ হয় বাসিন্দা মিলন বসাকের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রামে প্রায় ৫০০ পরিবারের বাস। গ্রামের প্ররুষোত্তমপুর, বসাকপাড়া, খুলুপাড়া, মোহন্তপাড়ায় জনবসতি আছে। এই পাড়াগুলোর প্রায় ৫০টি বাঁশঝাড়ে পাখিগুলো দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে।

বাঁশবাগানে বক পাখির আবাসস্থল।
ছবি: প্রথম আলো

মিলন বলেন, বাঁশঝাড়ে প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস পাখিগুলো বসবাস করে। খড়কুটা ডালপালা দিয়ে বাঁশবাগানে বাসা তৈরি করে। ডিম দেয়, বাচ্চা উড়তে শেখা পর্যন্ত বাঁশঝাড়ে বসবাস করে। এরপর গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি লক্ষ করছেন দিন দিন পাখিদের গ্রামে আসা কমতে শুরু করেছে।

গ্রামের বাসিন্দা মিতু বসাক কাহালু ডিগ্রি কলেজ থেকে এবার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জ্যাঠার নাম ছিল বিমল বসাক। তাঁর সামনে কেউ যদি পাখি শিকারে আসতেন, তাদের লাঠি দিয়ে ধাওয়া করতেন। আর বলতেন, ‘তোরা পাখি লিবার আচ্ছু। ওরা আমার বন্ধু। তোদের এক্কেরে থানায় দিয়া দিমু।’

মিতু বলেন, ‘এখন বলতে গেলে পাখি শিকারি কম আসে। কারণ, শিকারিদের বিরুদ্ধে গোটা গ্রাম এককাট্টা। কেউ পাখি শিকার করতে এলে গ্রামবাসী একজোট হয়ে শিকারিকে তাড়িয়ে দেন।’

দুর্গাপুর গ্রাম সম্পর্কে কাহালু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাছুদুর রহমান বলেন, প্রায় তিন বছর আগে তিনি নিজেও এই গ্রামে পাখির অভয়ারণ্যে দেখতে গিয়েছিলেন। উপজেলায় যোগদানের শুরুর দিকে পাখি শিকারের কিছু অভিযোগ পেতেন। কিন্তু এখন আর পান না। কারণ, পাখি শিকার বন্ধে স্থানীয় লোকজনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।