পাথর তোলার চেষ্টা, অভিযানে জেল-জরিমানা

নৌকা ও ভেলায় পাথর উত্তোলনযন্ত্র স্থাপন করে পাথর উত্তোলন অভিযোগে অভিযানে যন্ত্রগুলো জব্দ করে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট, ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর
ছবি: প্রথম আলো

গভীর গর্ত করে নিষিদ্ধ যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলনে পাথর কোয়ারিসহ আশপাশ এলাকা প্রায় ধ্বংসের মুখে। ঘটছিল শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনাও। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির এ অবস্থায় প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে পাথর উত্তোলন।

তবে বন্ধ পাথর কোয়ারিতে নৌকা ও ভেলায় পাথর উত্তোলনযন্ত্র স্থাপন করে ভাসমান পদ্ধতিতে পাথর তোলার চেষ্টা করছিল একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এমন অভিযোগে টাস্কফোর্সের অভিযানে ২০টি যন্ত্র জব্দ করা হয়। যন্ত্রগুলো ঘটনাস্থলে হাতুড়ি দিয়ে বিকল করে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন আচার্যের নেতৃত্বে টাস্কফোর্সের এই অভিযান হন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশের সমন্বয়ে এই অভিযান চালানো হয়।

টাস্কফোর্সের অভিযানে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খাগাইল গ্রামের মোহাম্মদ মাসুম ও সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শাহপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিন নামের দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুজনকে ২০ দিন করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া টাস্কফোর্সের অভিযানে অবৈধ যন্ত্র পরিচালনায় জড়িত তিন ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে দেড় লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও সুমন আচার্য প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বন্ধ পাথর কোয়ারিতে যেকোনোভাবে পাথর তোলার চেষ্টা অবৈধ কাজ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা পাঁচ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে ২০টি যন্ত্র জব্দ করে যন্ত্র চালনায় জড়িত ব্যক্তিদেরও জরিমানা করা হয়।

অভিযান–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ পাথর কোয়ারি থেকে কৌশলে পাথর উত্তোলন করতে যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। যন্ত্রগুলো কোনোটি বারকি নৌকার সঙ্গে যুক্ত আবার কোনোটি ভাসমান অবস্থায় ভেলায় স্থাপন করা। নৌকা ও ভেলায় ভ্রাম্যমাণ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন যন্ত্র স্থাপন করে পাথর তোলার সময় জব্দ করা হয় ২০টি যন্ত্র। এগুলো নৌকা ও ভেলার মধ্যে রেখে হাতুড়ি দিয়ে বিকল করে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়।
বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) তথ্য অনুযায়ী ভোলাগঞ্জ আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি। কালাসাদেক, ভারাই ও কালাইরাগ—এ তিনটি মৌজায় ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির আয়তন ৭৭০ দশমিক ১৪ একর। কোয়ারি থেকে দুই রকমের পাথর ‘বোল্ডার’ (বড়, সাদা পাথর) ও ‘সিঙ্গেল’ (ছোট) পাথর উত্তোলন হয়। এসব পাথর পাকা বাসাবাড়ি নির্মাণকাজে বেশি ব্যবহৃত হয়। বিএমডির মাধ্যমে জেলা প্রশাসন পাথর কোয়ারি ইজারা বন্দোবস্তের প্রচলন করে। ইজারার শর্তে আছে সনাতন (ম্যানুয়েল) পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন। তখন পাথর উত্তোলনে কেবল শ্রমিক ও বাহন বলতে ছিল লম্বা আকৃতির নৌকা (বারকি)। কম সময়ে দ্রুত পাথর তুলতে উত্তোলনকাজ যন্ত্রনির্ভর হয়, তখন থেকেই পরিবেশ ও পাথরশ্রমিকদের প্রাণহানি বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে পাথর কোয়ারিতে যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলন প্রচলন ঘটে। ‘বোমা মেশিন’সহ নানা নামে পরিচিত এসব যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে মূলত কম শ্রমিক ও কম সময়ে অধিক পাথর উত্তোলনে। বোমা মেশিন মূলত পাওয়ার পাম্প আর পাইপ দিয়ে তৈরি যন্ত্র। এ যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ মাটির স্তর পরিবর্তিত হয়ে ভূপ্রকৃতি, পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি পাথরশ্রমিক হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। উচ্চ আদালতে আবেদন করলে ২০০৯ সাল থেকে ‘বোমা মেশিন’সহ যন্ত্র দিয়ে পাথর তোলা নিষিদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে এ-সংক্রান্ত অভিযান পরিচালনা করতে নির্দেশনা জারি হয়।

বেলার হিসাব অনুযায়ী, যন্ত্র দিয়ে পাথর তুলতে গিয়ে ভোলাগঞ্জসহ সিলেটের সাতটি পাথর কোয়ারিতে ২০০৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৯৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিক হতাহত হওয়ার অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে কোম্পানীগঞ্জে।