বরিশাল বিভাগে পানিতে ডুবে মৃত্যু এখন ‘মহামারি’

পানিতে ডুবে মৃত্যু
প্রতীকী ছবি

‘ধান, নদী, খাল—এই নিয়ে বরিশাল।’ প্রচলিত এ কথায় দক্ষিণের বিভাগ বরিশালের সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির জানান দেওয়া হয়। বিভাগটির কয়েকটি জেলার গ্রামাঞ্চলে সড়কপথের চেয়ে নদী বা খাল দিয়ে যাতায়াতও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু ভৌগোলিক এই সুবিধাই ‘মহামারির’ মতো প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের। শুধু গত বছরেই নদী বা খালে ডুবে সারা দেশে ৭৭৯ জন মারা গেছে।

বরিশাল বিভাগের ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে ‘মহামারি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন শিশু ও বিভিন্ন দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) পরিচালক আমিনুর রহমান বলেন, সবার ধারণা দেশে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। কিন্তু আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে কোনো তথ্যও থাকে না। ফলে শিশুমৃত্যুর এই ভয়ংকর চিত্রটি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।

সিআইপিআরবির অক্টোবর ২০১৬ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৭–এর পরিসংখ্যান বলছে, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি বরিশালে। প্রতিদিন গড়ে এই বিভাগে ৯ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, যা দেশের অন্য এলাকার তুলনায় তিন গুণ বেশি।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ধরে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপ করে গণমাধ্যমবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা সমষ্টি। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৪২৫টি ঘটনায় ৭৭৯ জন পানিতে ডুবে মারা যান। যার ৮২ শতাংশই শিশু। বয়সভেদে ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি মারা গেছে। এ সংখ্যা ২৫৮। শূন্য থেকে ৪ বছর বয়সী ২৪৮, ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৯৯ এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ২৮ জন।

এ ছাড়া গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার পটুয়াখালীতে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পিরোজপুর। পটুয়াখালীতে ১১ মাসে ১৭, পিরোজপুরে ১২, বরিশালে ১১ জন, ভোলা ও ঝালকাঠিতে ৮ জন করে এবং বরগুনায় ৩ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে।

স্থানীয় পর্যায় ছাড়াও পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা উঠে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনেও। ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ড্রনিং’ শিরোনামে সংস্থাটির ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। তাদের ২০ শতাংশের বয়স ৫ বছরের কম। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হারে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৪৩ শতাংশ হয়েছে পানিতে ডুবে। অবশ্য ২০১৪ সালে সংস্থাটি বলেছিল, সারা দেশে গড়ে ৪০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।

সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যেই সাধারণত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। এ সময় মায়েরা সাংসারিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাবারা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যান। গ্রামে সন্ধ্যার দিকে হাত-মুখ ধুতে গিয়েও ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। আর বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে মৃত্যুহার বেশি।

এদিকে ২০১৬ সালে দুর্ঘটনার ধরন অনুযায়ী একটি শ্রেণি প্রকাশ করে বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে (বিএইচআইএস)। ওই শ্রেণি অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে আত্মহত্যাজনিত কারণে। ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ দশমিক ৪ এবং পানিতে ডুবে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ।

সবার ধারণা দেশে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। কিন্তু আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে কোনো তথ্যও থাকে না। ফলে শিশুমৃত্যুর এই ভয়ংকর চিত্রটি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
আমিনুর রহমান, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) পরিচালক

বিএইচআইএসের প্রতিবেদন বলছে, সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যেই সাধারণত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। এ সময় মায়েরা সাংসারিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাবারা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যান। গ্রামে সন্ধ্যার দিকে হাত-মুখ ধুতে গিয়েও ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। আর বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে মৃত্যুহার বেশি। কারণ, ওই সময় জোয়ার বা বন্যার কারণে নদী ও খালের পানি বসতবাড়ির আশপাশে চলে আসে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ী বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকে বৈশ্বিকভাবে এসডিজির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুকে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ফলে অসুস্থতাজনিত কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমছে না।

২০১৬ সালে দুর্ঘটনার ধরন অনুযায়ী একটি শ্রেণি প্রকাশ করে বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে (বিএইচআইএস)। ওই শ্রেণি অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে আত্মহত্যাজনিত কারণে। ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ দশমিক ৪ এবং পানিতে ডুবে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ।

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অসীম কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারের বড় সদস্যদের সচেতন থাকতে হবে। পানিতে ডুবে যাওয়া শিশুকে ওপরে ওঠানোর পর সিপিআর (কার্ডিও-পালমোনারি রিসাসিটেশন) পদ্ধতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে মুখে মুখ লাগিয়ে ও পেটে হালকা চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করা হয়। রোগী নিজে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে শুরু করলে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।