পাবনায় খেলার মাঠ ও পার্ক নেই, উঠছে বড় বড় ভবন

‘ব্যস্ত শহরে, ঠাসবুনোটের ভিড়ে, আজও কিছু মানুষ স্বপ্ন খুঁজে ফেরে...।’ শিল্পী অর্ণবের গানের কথাগুলোর মতোই যেন শহরের এই চিত্র। কংক্রিটের দালানকোঠার ভিড়ে বুকভরে একটু নিশ্বাস নেওয়ার ইচ্ছাটাই যেন নগরবাসীর কাছে স্বপ্ন খুঁজে ফেরার মতো। সম্প্রতি পাবনা শহর থেকে তোলা।  ছবি: হাসান মাহমুদ
‘ব্যস্ত শহরে, ঠাসবুনোটের ভিড়ে, আজও কিছু মানুষ স্বপ্ন খুঁজে ফেরে...।’ শিল্পী অর্ণবের গানের কথাগুলোর মতোই যেন শহরের এই চিত্র। কংক্রিটের দালানকোঠার ভিড়ে বুকভরে একটু নিশ্বাস নেওয়ার ইচ্ছাটাই যেন নগরবাসীর কাছে স্বপ্ন খুঁজে ফেরার মতো। সম্প্রতি পাবনা শহর থেকে তোলা। ছবি: হাসান মাহমুদ

বিকেল চারটা। যানবাহনের জট পাবনার শহরের প্রধান সড়কে। সড়কের এক পাশ দিয়ে দুই শিশুকন্যার হাত ধরে হাঁটছিলেন পাবনা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক আবদুল খালেক। বাবার হাত ছেড়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করছিল শিশুরা। কিন্তু আবদুল খালেক বারবার তাদের সাবধান করছিলেন। হাতের মুঠোয় আগলে রাখছিলেন দুই শিশুর হাত।

কথা হলো আবদুল খালেকের সঙ্গে। শহুরে রাস্তায় শিশুদের মনের মতো ঘুরে বেড়ানো যে নিরাপদ নয়, তা আবদুল খালেক ও তাঁর দুই কন্যাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু শিশুদের নিয়ে সড়কে হাঁটতে বের হওয়া কেন? আবদুল খালেক বলছিলেন, স্বামী-স্ত্রী দুজনই শিক্ষকতা করেন। সারা দিন বাচ্চাদের সময় দিতে পারেন না। বিকেলে বের হন কিন্তু শহরে শিশুদের নিয়ে সময় কাটানোর কোনো জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় হাঁটা।

আবদুল খালেকের মতো পাবনা জেলা শহরের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, শহরে প্রতিনিয়ত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠছে। কিন্তু শিশু-তরুণ, যুবক-বৃদ্ধদের অবসর কাটানোর ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ব্যস্ত শহুরে জীবনে একটুখানি প্রশান্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা।

যেমনটি বলছিলেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং জেলা প্রশাসনের নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য সোহেল রানাও। বলেন, পাবনা জেলা শহরের মূল সমস্যা হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। শহরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, শিশুপার্ক ও অবকাশ যাপনের স্থান নেই। পরিকল্পনা ছাড়াই একের পর এক অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। এতে শহর ঘিঞ্জি হচ্ছে, যানজট ও অগ্নিঝুঁকি এবং জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।

উন্মুক্ত পরিবেশ কতটা জরুরি? পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তন্ময় প্রকাশ বলছেন, সঠিক বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগ না থাকলে শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তৈরি করে বিষণ্নতা। কমে উদ্ভাবনী ক্ষমতা। একই প্রভাব পড়ে তরুণদের ওপর। ফলে অনেকেই বেছে নেন মাদক। ঘরবন্দী থাকলে বয়স্ক ব্যক্তিদেরও মানসিক চাপ বাড়ে।

পাবনা পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, জেলা সদরের মধ্যে শুধু পৌর এলাকার আয়তন ২৭ দশমিক ২০ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা প্রায় দুই লাখ। ছোট্ট আয়তনের শহরটিতে রয়েছে ১০টি হাটবাজার, ৪টি ভারী শিল্পকারখানা, ৪৫টি মাঝারি শিল্পকারখানা ও ২৮০টি ক্ষুদ্র কলকারখানা। এর মধ্যেই বিনোদন ও অবকাশ যাপনের জন্য রয়েছে একটি স্টেডিয়াম, একটি শিশুপার্ক, একটি সিনেমা হল ও পাঁচটি সরকারি–বেসরকারি পাঠাগার। 

গত মঙ্গলবার বিকেলে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, জেনারেল হাসপাতাল ও সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে তিনটি সড়ক এসে মিশেছে শহরের আবদুল হামিদ সড়কে। মূল সড়কটির দুই পাশে ছোট–বড় ভবন। কিন্তু এগুলোতে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় জট তৈরি হচ্ছে সড়কে। এই সড়ক ধরেই যেতে হয় শহরের একমাত্র শেখ রাসেল শিশুপার্কে। পার্কটিতে থাকা দুটি রাইডসের সব কটি অকেজো। ফলে শিশুদের তেমন উপস্থিতি দেখা গেল না। শহরের সরকারি গ্রন্থাগারটিও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের পাশে। চারপাশে ময়লা–আবর্জনায় ঠাসা। পাঠকশূন্য গ্রন্থাগারটি। 

এই যান্ত্রিকতা ছেড়ে উন্মুক্ত স্থানে যাওয়ার ইচ্ছা থেকেই যেন নগরবাসীর ভিড় দেখা গেল সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে। সেখানে হাঁটছিলেন কলেজশিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী। তিনি বলেন, শহরে ভেতর একটু বসার জায়গা নেই। শিশুদের জন্য নেই বিনোদনের জায়গাও। শহরের একমাত্র ইছামতী নদীটিও দখল আর দূষণে মরা খালে পরিণত হয়েছে। এতে শহরবাসীর বুকভরে নিশ্বাস নেওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়ছে।

শিশু ছেলেকে নিয়ে মাঠে বসেছিলেন গৃহিণী নুসরাত জাহান। তিনি বলেন, বিকেল হলেই বাচ্চা ঘরে থাকতে চায় না। প্রতিদিন বাইরে বের হতে হয়। শহরের ভেতর কলেজ ক্যাম্পাসটাই উন্মুক্ত জায়গা হওয়া এখানে সবাই আসেন। দিনে দিনে এই এলাকাও ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে।

পাবনা পৌরসভার মেয়র কামরুল হাসান বলেন, শহরকে সুন্দর করতে বিনোদন ও অবকাশ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত জমি ও অর্থসংকটে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।