পাহাড়, টিলা, হাওর, বনের হবিগঞ্জ

দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত বনটির আয়তন প্রায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর
ছবি: প্রথম আলো

দিগন্তজোড়া পাহাড় ও ছোট ছোট টিলা। এর মধ্যে মনোমুগ্ধকর সারি সারি চা-বাগান। রয়েছে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর প্রাকৃতিক বন। নান্দনিক এসব বনের অতি প্রাচীন বৃক্ষ আর নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী বিমোহিত করে যে কাউকে। হাওরসমৃদ্ধ হবিগঞ্জ জেলায় ঐতিহাসিক সাগরদিঘি, উচাইল শংকরপাশা শাহী মসজিদ ও বিথঙ্গল আখড়ার মতো ঐতিহাসিক স্থাপনাও রয়েছে।

দেশ–বিদেশের মানুষের কাছে হবিগঞ্জকে তুলে ধরে জেলা প্রশাসন তাই স্লোগান ঠিক করেছে ‘পাহাড় টিলা হাওর বন হবিগঞ্জের পর্যটন’। পাহাড়ি বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।

প্রাকৃতিক পাহাড়ি বন রেমা-কালেঙ্গা

রেমা-কালেঙ্গা ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে দেখা মিলবে মায়া হরিণ, মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, মেছো বাঘ, বন্য শুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, শজারুর সঙ্গে। এ রকম ৩৭ প্রজাতির বন্য প্রাণী ও স্তন্যপায়ী আছে এ বনে। সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি ছাড়া আছে ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম।

দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। প্রায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এ বনভূমি অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এর পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৭ মিটার।

রেমা-কালেঙ্গার বনে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালির মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালির একমাত্র বসবাস এ বনেই। তিন প্রজাতির বানর কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতীর দেখা মেলে এ অভয়ারণ্যে। এ বনে ১৮ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াস ও লাউডগা আছে।

১৬৭ প্রজাতির পাখির মধ্যে ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবাউরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, প্যাঁচা, মাছরাঙা, ইগল, চিলসহ নানা জাতের পাখি দেখার সুযোগ আছে এ বনে।

এ বন প্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃত
ছবি: প্রথম আলো

এ বন্যপ্রাণী-অভয়াশ্রমে আছে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল বা পথ। প্রতিটি ছবির মতো সুন্দর আর সাজানো। এ অভয়ারণ্যের ভেতর আরও আছে একটি সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারটির মাথা বনের উঁচু উঁচু গাছের উচ্চতা ভেদ করে আকাশে উঁকি দিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় বনের ভেতরের দূর-দূরান্তের সবুজ দৃশ্য। ঠিক টাওয়ারের নিচেই আছে আঁকাবাঁকা একটি লেক।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারাও দেখা যেতে পারে এখানে। ত্রিপুরা, সাঁওতাল, তেলুগু ও উড়ং সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বসবাস আছে এ বনের ভেতরেই। কালেঙ্গায় থাকার জন্য আছে বন বিভাগের বিশ্রামাগার। সেখানে অবস্থান করতে হলে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমোদন লাগবে।

সাগরদিঘি

স্বচ্ছ চকচকে জলে ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর সূর্যের আলো নেচে বেড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ছোট ছোট প্রদীপ ভাসছে। সবুজ বেষ্টনির মাঝখানে বিশাল দিঘিটি দেখতে অনেকটা সাগরের মতো। যে কারণে সবাই সাগরদিঘি বলে। এ দিঘির পাড়ে বসেই পল্লি কবি জসিমউদ্দিন ‘রাণী কমলাবতীর দিঘি’ নামের কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এ দিঘি নিয়ে বাংলা ছায়াছবিসহ রেডিও, মঞ্চনাটক রচিত হয়েছে।

হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে যেকোনো পরিবহনে বানিয়াচং সাগরদিঘিতে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট
ছবি: প্রথম আলো

বানিয়াচং উপজেলা সদরে অবস্থিত দিঘিটি জেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দিঘিটি দেখতে প্রতিদিন দেশের নানা জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ আসে বেড়াতে। দিঘিটি আয়তনের দিক থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাধার হিসেবে স্বীকৃত। এর আয়তন ৬৬ একর। হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে যেকোনো পরিবহনে বানিয়াচং সাগরদিঘিতে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট।

চুনারুঘাট, মাধবপুর, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশে রয়েছে ২৪টি চা-বাগান। চা-বাগানগুলোর নৈসর্গিক দৃশ্য সহজেই দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।

ঐতিহ্যের উচাইল শংকরপাশা শাহি মসজিদ

৫০৫ বছরের পুরোনো উচাইল শংকরপাশা শাহি মসজিদটি চুন-সুরকি আর লাল ইট দিয়ে তৈরি। মসজিদের নকশা ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনি দৃষ্টি কাড়ে সবার। যে কারণে হবিগঞ্জে কেউ বেড়াতে এলেই মসজিদটির স্থাপত্য নান্দনিকতা দেখতে আসে।

দেশের পুরাকীর্তিগুলোর যে গড়পড়তা বিধ্বস্ত চেহারা, সে তুলনায় উচাইল শংকরপাশা মসজিদের অবস্থা যথেষ্ট ভালো। প্রাঙ্গণটি নিরিবিলি এবং খুবই পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। মসজিদের চারপাশ সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা। পাশাপাশি খেজুরগাছের সারিতে ঘেরা চত্বরটি পুরো মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। গম্বুজওয়ালা প্রাচীন স্থাপত্যটিকে বেশ মনোরম দেখায় এ প্রাকৃতিক পরিবেশে।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রাজিউড়া ইউনিয়নের উচাইল গ্রামে এ মসজিদের অবস্থান। হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে এ মসজিদের দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার।

মসজিদ ভবনটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ একই মাপের, যা ২১ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর সম্মুখের বারান্দাটির প্রস্থ তিন ফুটের সামান্য বেশি। এতে চারটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটিতে মোট ১৫টি দরজা ও জানালা রয়েছে, যা পরস্পর সমান আকৃতির প্রায়।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রাজিউড়া ইউনিয়নের উচাইল গ্রামে শংকরপাশা শাহি মসজিদের অবস্থান। হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে এ মসজিদের দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার
ছবি: প্রথম আলো

উচাইল শংকরপাশা শাহি মসজিদ প্রত্ননিদর্শন হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫১৩ সালে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়া এই মসজিদ নির্মাণ করেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মজলিশ আমিন। মসজিদের পাশেই আছে তাঁর মাজার।

বিথঙ্গলের আখড়া

বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান বিথঙ্গলের আখড়া। এটি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত ভাটি এলাকা বিথঙ্গল গ্রামে অবস্থিত। এর প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামী। তিনি উপমহাদেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান সফর শেষে ষোড়শ শতাব্দীতে বিথঙ্গল গ্রামে আখড়াটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ আখড়ায় ১২০ জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। এই আখড়ায় বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়। এ আখড়ায় দর্শনীয় বিষয়টি হচ্ছে ২৫ মণ ওজনের শ্বেতপাথরের চৌকি, পিতলের তৈরি সিংহাসন, সুসজ্জিত রথ, রৌপ্য পাত্র ও একটি সোনার মুকুট। যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে বিথঙ্গলে আখড়ায় ভ্রমণের সময় বর্ষা মৌসুমে। হাওরে পানি যখন ঢেউ খেলে, তখন নৌকায় বেড়ানোর জন্য অতি সহজ এ তীর্থস্থান। সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান

দেশে যে ১০টি জাতীয় উদ্যান আছে, তার মধ্যে সাতছড়ি অন্যতম। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর প্রাকৃতিক এ বন চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে ৬০০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতর সাতটি ছড়া বা ঝরনা আছে। এখান থেকে এর নামকরণ করা হয় সাতছড়ি। এই জাতীয় উদ্যানকে ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট বা মিশ্র চির সবুজ এবং পাতাঝরা বন বলা হয়ে থাকে। উদ্যানের আশপাশে ৯টি চা-বাগান আছে। উদ্যানের পশ্চিম দিকে সাতছড়ি চা–বাগান এবং পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা-বাগান অবস্থিত। উদ্যানের অভ্যন্তরভাগে টিপরাপাড়ায় ২৪টি পরিবার বসবাস করে।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানকে ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট বা মিশ্র চির সবুজ এবং পাতাঝরা বন বলা হয়ে থাকে
ছবি: প্রথম আলো

জীববৈচিত্র্যময় এ উদ্যানে ১৯৭ প্রজাতির জীব-জন্তু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর। আরও আছে প্রায় ১৫০-২০০ প্রজাতির পাখি। এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের একটি অভয়াশ্রম। বনে লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, কুলু বানর, মেছো বাঘ, মায়া ইত্যাদির দেখা মেলে।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে রয়েছে ২০০ প্রজাতির বেশি গাছপালা। এর মধ্যে শাল, সেগুন, আগর, গর্জন, চাপালিশ, পাম, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর, জাম, জামরুল, সিধাজারুল, আওয়াল, মালেকাস, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, বাঁশ, বেতগাছসহ নাম না জানা নানান গাছগাছালি। গাছে গাছে উড়ে বেড়ানো শ্যামা, ময়না, বসন্ত বাউরী, ফোটা কণ্ঠী সাতবাইলাসহ নানা পাখির সুমধুর ধ্বনিতে মুখর হয়ে থাকে পুরোটা বন।

হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে সাতছড়ির দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার। শায়েস্তাগঞ্জ সদর থেকে যাতায়াত খুবই সহজ, সময় লাগে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। শ্রীমঙ্গল থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এ উদ্যান। ঢাকা থেকে যাঁরা আসতে চান, তাঁদের ১৩০ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে আসতে হবে স্বপ্নের এ স্থানে।

এ ছাড়া চুনারুঘাট, মাধবপুর, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশে রয়েছে ২৪টি চা-বাগান। চা-বাগানগুলোর নৈসর্গিক দৃশ্য সহজেই দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে। শাহজিবাজার ও বাহুবলের রুপাই ছড়ায় রয়েছে দুটি বড় রাবার বাগান, শাহজিবাজার ও রশিদপুরে রয়েছে তিনটি গ্যাস ফিল্ড। নবীগঞ্জ উপজেলার বিয়িনায় আছে দেশের অন্যতম গ্যাস ফিল্ড ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এ ছাড়া মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ভিতরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেট আকৃতির স্মৃতিসৌধ।