পাহাড়ি ঢলে টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালি এলাকায় ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরে ঢলের পানি ঢুকছে। ছবিটি আজ শনিবার বিকেলে তোলা
ছবি: খলিল রহমান

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে প্রায় ২০০ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে বাঁধটি ভেঙে যায়।

সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গুয়ার হাওরের ভেঙে যাওয়া ওই বাঁধের অবস্থান। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পাহাড়ি ঢলের পানি দ্রুত বেগে হাওরে ঢুকছে। সেখানে উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে বাঁধটি ভেঙেছে, সেটি নজরখালি বাঁধ হিসেবে পরিচিত। টাঙ্গুয়ার হাওরে নজরখালি হয়েই পানি প্রবেশ করে। খালের মুখে আড়াআড়িভাবে মাটি দিয়ে বাঁধটি দেওয়া হয়েছিল। চার দিন আগেই পাটলাই নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। শুক্রবার রাতে থেকে পানি ব্যাপক হারে বাড়তে থাকলে স্থানীয় লোকজন বাঁধে বাঁশ-চাটাই দিয়ে আড় দিয়ে সেটি রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে বাঁধ উপচে পানি হাওরে ঢুকতে থাকে। একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাঁধটি ভেঙে যায়।

গোলাবাড়ী গ্রামের কৃষক খসরু মিয়া (৫০) বলেন, প্রথমে বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢুকে। পরে বাঁধ ভেঙে যায়। ২০১৭ সালের পর এই সময়ে এত বেশি ঢলের পানি আর আসেনি।

জয়পুর গ্রামের কৃষক আয়নাল মিয়া (৬০) বলেন, তাঁর দুই একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। সবাই মিলে চেষ্টা করেও বাঁধটি রক্ষা করতে পারেননি তাঁরা।

বাঁধের পাশেই টাঙ্গুয়ার হাওরে গোলাবাড়ি আনসার ক্যাম্প। ক্যাম্পের কমান্ডার মানিক মিয়া বলেন, ‘আমরাও কৃষকদের সঙ্গে বাঁধে সারা রাত ছিলাম। কাজ করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁধটি আর রক্ষা করা যায়নি।’

বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে সকালেই সেখানে ছুটে যান তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর একটি সংরক্ষিত জলাভূমি। এটা ফসলি হাওর নয়। এখানে বাঁধ দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। বাঁধটি স্থানীয় কৃষকেরা তাঁদের প্রয়োজনে দিয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নকশা অনুযায়ী কোনো কাজ হয়নি এখানে। তবে এবার কৃষক ও স্থানীয় লোকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কাজ হয়েছিল। তবে উপজেলার প্রধান ফসলি হাওরগুলো এখনো সুরক্ষিত আছে।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে একেবারে ফসল হয় না, এটা ঠিক নয়। প্রায় ২০০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। তবে এই হাওরে বাঁধ দেওয়া পরিবেশসম্মত নয়, তাই বাঁধ দেওয়া হয় না। উজানে ব্যাপক বৃষ্টি হওয়ায় উপজেলার অন্যান্য হাওরের ফসলও ঝুঁকিতে আছে। সবাইকে বাঁধে অবস্থান করতে অনুরোধ করা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ৪৮ ঘণ্টায় ৫৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাই ব্যাপক পরিমাণে ঢল নেমেছে। সুনামগঞ্জের নদী ও হাওরে পানি বাড়ছে। যে বাঁধটি উপচে হাওরে পানি ঢুকেছে, সেটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পভুক্ত কোনো কাজ নয়। তাঁরা পুরো জেলায় বাঁধের কাজের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে সতর্ক করেছেন। জেলা প্রশাসন থেকেও উপজেলা পর্যায়ে একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম প্রথম আলোকে বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে ফসল কম হয়। এখানে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল ১২০ হেক্টর। বাঁধ ভেঙে পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ২৫ হেক্টরের মতো। তিনি জানান, এবার সুনামগঞ্জ জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। আর সপ্তাহখানেক পরই ধান কাটা শুরু হবে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার ফসল পাবেন কৃষকেরা।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহরুল ইসলাম জানান, এবার সুনামগঞ্জে ৭২৯টি প্রকল্পে ৫২০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ হয়েছে। এতে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজের সময়সীমা ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এবারও সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ হয়নি।