পিপিই ছাড়াই এই চেম্বারে বসে রোগী দেখতে পারবেন চিকিৎসকেরা

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য তৈরি ‘নির্ণায়ক আইসোলেশন চেম্বার ফর ডক্টরস’। ছবি সংগৃহীত
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য তৈরি ‘নির্ণায়ক আইসোলেশন চেম্বার ফর ডক্টরস’। ছবি সংগৃহীত

করোনাভাইরাসে চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সেবাদানকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। চিকিৎসক ও সেবাকর্মীরা যাতে নিরাপদ অবস্থানে থেকে সেবা দিতে পারেন, সে জন্য ‘নির্ণায়ক আইসোলেশন চেম্বার ফর ডক্টরস’ নামে একটি সুরক্ষিত চেম্বার তৈরি করা হয়েছে। চেম্বারের ভেতর বসে চিকিৎসক বা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী রোগীর প্রাথমিক পরীক্ষার কাজটি করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য চেম্বারের চেয়ে এ চেম্বারের বিশেষত্ব হচ্ছে, এ চেম্বারে বিশেষ সুরক্ষিত পোশাক বা পিপিই না পরে সাধারণ পোশাকেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা দিতে পারবেন। এতে রোগীর শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকলেও চিকিৎসকের সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ নেই।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ফেসবুক গ্রুপ ‘টিম এসওএস’–এর সদস্যদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে এই আইসোলেশন চেম্বারের নকশা করেছে ‘ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড’ নামে স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান। হাসপাতাল, কারখানা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রবেশপথে এই বুথের সাহায্যে রোগী পৃথককরণের মাধ্যমে ‘সংক্রমণমুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা’ নিশ্চিত করা যাবে। গতকাল রোববার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর ‘নির্ণায়ক আইসোলেশন চেম্বার ফর ডক্টরস বুথ’–এর একটি নমুনা কপি বিনা মূল্যে হস্তান্তর করা–বিষয়ক একটি চিঠি পাঠিয়েছেন ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেডের স্থপতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হাবিব।

নতুন নকশায় বানানো চেম্বারটি উন্মুক্ত জায়গায় ব্যবহার করা যাবে, একইভাবে ‘বৃষ্টি ছাদ’ সরিয়ে ঘরের ভেতরে ব্যবহারের উপযোগী করা যাবে। ঘরের শীতাতপনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার সঙ্গেও যুক্ত করা সম্ভব হবে এই চেম্বারকে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই হাসপাতালের বহির্বিভাগের সাধারণ রোগীদের পরামর্শ দেওয়ার জন্যও এটি ব্যবহার করা যাবে।

ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের কেরালাসহ বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের চেম্বার তৈরি করা হয়েছে। তাই এটি একেবারেই নতুন কোনো উদ্ভাবন তা বলা যাবে না। তবে আমার নকশায় তৈরি করা চেম্বারে পিপিই পরার ঝামেলাটা এড়ানো গেছে। গরমে পিপিই পরে চিকিৎসকেরা খুব অস্বস্তিতে থাকেন। সরকার বর্তমান এ চেম্বার অনুমোদন করলে একজন চিকিৎসক চাইলে টি–শার্ট গায়ে দিয়েও দীর্ঘ সময় ধরে তিনি কাজ করতে পারবেন। রোগী দেখতে পারবেন।’

ইকবাল হাবিব টেলিফোনে জানিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য নির্মাণসামগ্রী দিয়ে চেম্বারটি তৈরি করা হয়েছে।

এ চেম্বারের স্থাপত্যকৌশল বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেওয়া চিঠিতেও জানানো হয়েছে, চেম্বারে যান্ত্রিকভাবে নিচের দিক থেকে পরিশোধিত বায়ু প্রবেশ ও ওপর থেকে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ বাতাসের একমুখী নির্গমনব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

যান্ত্রিকভাবে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে কথোপকথনসুবিধা, লম্বা গ্লাভসের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী তাঁর দুই হাত রেখে স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে রোগীর প্রাথমিক পরীক্ষা, লেজার থার্মোমিটারের মাধ্যমে তাপমাত্রা মাপতে পারবেন। ভেতরে ডেস্কে ল্যাপটপ রেখে তার সঙ্গে ওয়াই–ফাই প্রযুক্তিতে বাইরে প্রিন্টার যুক্ত করে প্রেসকিপশন দেওয়ারও সুযোগ রাখা হয়েছে।

ফেসবুক গ্রুপ ‘টিম এসওএস’–এর উদ্যোগে নিজের করা নকশায় তৈরি বুথের সামনে স্থপতি ইকবাল হাবিব ও অন্যরা। ছবি: সংগৃহীত
ফেসবুক গ্রুপ ‘টিম এসওএস’–এর উদ্যোগে নিজের করা নকশায় তৈরি বুথের সামনে স্থপতি ইকবাল হাবিব ও অন্যরা। ছবি: সংগৃহীত

চেম্বারে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদ্যুৎব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আইপিএস ব্যবহার করা হয়েছে। দুই স্তরে ছাদ থাকায় স্বাভাবিক বায়ু চলাচলের মাধ্যমে নিচের মূল চেম্বারটিকে প্রকৃতি নির্ভতায় ঠান্ডা রাখার পাশাপাশি বৃষ্টি থেকেও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ইকবাল হাবিব জানান, দক্ষ কারিগর আর পেশাজীবী প্রকৌশলী বা স্থপতির প্রাথমিক তত্ত্বাবধানে সংযুক্ত নকশা অনুযায়ী যথাযথ নির্মাণ নিশ্চিত করে দেশের যেকোনো স্থানে এটি নির্মাণ করা সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে বানালে উৎপাদন খরচও কমে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিঠিতে ‘নির্ণায়ক আইসোলেশন চেম্বার ফর ডক্টরস’ বুথের একটি নমুনা কপি হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড বিনা মূল্যে হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছে। অধিদপ্তরের চিঠির উত্তর পাওয়ার পর পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হবে প্রতিষ্ঠানটি।

‘টিম এসওএস’–এর মডারেটর সৈয়দ সাইফুল আলম বলেন, ‘আমাদের ফেসবুক দলের সদস্যরা বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিনা মূল্যে পিপিই বিতরণ করে। তখনই চিন্তাটা মাথায় আসে। স্থপতি ইকবাল হাবিব, ভাইরোলজিস্ট জাহিদুর রহমানকে পরিকল্পনার কথা জানাই। তারপর মূলত এ দুজনই সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে চেম্বারটি বানিয়েছেন। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু একটি বানানো হয়েছে, এ ছাড়া করোনাভাইরাসের বিস্তারে শ্রমিক পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে খরচটা বেশি লেগেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং সংখ্যা বাড়লে খরচটা খুব বেশি হবে না। এখন আমরা সরকারের মতামতের অপেক্ষায় আছি।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ভাইরোলজিস্ট জাহিদুর রহমান বললেন, ‘ইকবাল হাবিবের নকশায় যে বুথটি বানানো হয়েছে, তাতে একজন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী করোনার স্যাম্পল কালেকশনের পাশাপাশি রোগীও দেখতে পাচ্ছেন। অর্থাৎ রোগী এক জায়গা থেকেই সেবাটা পাবেন। বলা যায়, বুথটি যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, তা কারিগরিগত দিক থেকে ঠিক আছে। আর বাস্তবিক প্রয়োগে সমস্যা অনুযায়ী তাতে সংযোজন বা বিয়োজন করা সম্ভব।’

ভাইরোলজিস্ট জাহিদুর রহমান বলেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মোবাইল স্যাম্পল কালেকশন বুথ কাজ করছে। নতুন নকশার বুথটিকেও মোবাইল বুথ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।