পুলিশের ভয়ে পুরুষশূন্য গ্রামটিতে লাশ সৎকারের কেউ ছিল না

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রামপাড়া গ্রামের নীলা পুলিশের অভিযানের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। ছবিটি রোববার দুপুরে তোলা
ছবি: শহীদুল ইসলাম

পুলিশের ভয়ে মালঞ্চ রায়ের লাশের সৎকার করতে আসেননি গ্রামের কোনো মানুষ। এমনকি তাঁর নিজের ছেলে-নাতিও আসেননি। পরে পাশের গ্রামের লোকজন ও দূর থেকে আসা আত্মীয়স্বজন তাঁর শেষকৃত্য করেছেন। আজ রোববার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রামপাড়া গ্রামে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়।

রামপাড়া ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অধ্যুষিত একটি গ্রাম। এখানে ৩৬টি পরিবারের বাস। গ্রামে চারটি মুসলিম পরিবার আছে। ওই বাড়িগুলোতেও কোনো পুরুষ নেই।

গত শুক্রবার পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় এই গ্রামের ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৩০ থেকে ৪০ জনকে আসামি করে গোদাগাড়ী থানায় মামলা হয়। এ মামলায় গ্রামের সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে রামপাড়া গ্রামের পুরুষেরা বাড়ি ছেড়েছেন।

স্থানীয় কয়েকজনের ভাষ্য, গ্রামের বাসিন্দা আনন্দ রায়ের নামে চোলাই মদ তৈরির মামলা রয়েছে। সেই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে সাদাপোশাকে দুজন পুলিশ তাঁকে ধরতে যান। স্বজনেরা তখন তাঁকে পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নেন। তাঁরা একজন পুলিশকে আটকে মারধর করেন। অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে ওই পুলিশকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

ওই গ্রামের কয়েকজন নারীর ভাষ্য, ঘটনার দিন রাতে পুলিশ ওই গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ব্যাপক তছনছ করে। মালঞ্চ রায়ের বাড়িতে শুক্রবার পুলিশ অভিযান চালায়। আজ রোববার ভোর রাতে তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০ বছর। তাঁর ছেলে শচীন রায় ও নাতি চয়ন রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে গত শুক্রবার থেকে পালিয়ে আছেন।

আজ দুপুরে মালঞ্চ রায়ের বাড়িতে গেলে তাঁর পুত্রবধূ শিখা রায় বললেন, তাঁদের বাড়ির কেউ পুলিশের ওপর হামলা করতে যাননি। তাঁরা কিছুই জানেন না। পুলিশ শুক্রবার রাতে এসে তাদের ঘরের দরজা, বাথরুমের দরজা ও হাঁড়ি–পাতিল ভাঙচুর করে গেছে। শাশুড়ি মারা গেলেও তাঁর স্বামী মায়ের সৎকারের জন্য বাড়িতে আসতে পারেননি।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের রাজশাহী জেলার সভাপতি বিমল চন্দ্র রাজোয়াড় বলেন, গ্রামে কোনো পুরুষ মানুষ নেই দেখে তিনি পাশের গ্রামের কয়েকজনকে ডেকে মালঞ্চ রায়ের সৎকারের ব্যবস্থা করেন। পুলিশের এই অভিযান অব্যাহত থাকলে তাঁরা মানববন্ধন করবেন।

পলাতক আনন্দ রায়ের বাড়িতে কেউ নেই। একতলা পাকা বাড়িটি ফাঁকা পড়ে আছে। একটি দরজায় তালা দেওয়া, আরেকটি ভাঙা। পাশের বাড়ির নীলা (৬৫) বলেন, আনন্দ রায়কে পুলিশ ধরে মোটরসাইকেলে তুলছিল। কিন্তু তিনি নেমে যান। তিনি উঠে গেলে গ্রামের অন্যদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। এ ছাড়া ঘটনার সময় পাশের গ্রাম থেকে এক যুবক এসে বলেন, যাঁরা এসেছেন, তাঁরা পুলিশের লোক নন। পুলিশ হলে গায়ে পোশাক থাকত। তিনি সাদাপোশাকে থাকা দুই পুলিশকে আটকাতে বলেন। এরপরই পুলিশকে মারধরের ঘটনা ঘটে।

নীলা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের নিজের জমি নাই। গৃহস্থের জমির ধান সব পাইকে গ্যাছে। এই ধান কাইটে চাল করে ঘরে তুইলে দিতে হবে। এখন আমরা কী করব?’

এ ব্যাপারে গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এক নেতা ও আওয়ামী লীগের নেতারা এসেছিলেন। তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছে, লাশ দাফনের সময় কোনো অভিযান চালানো হবে না। রামপাড়া গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি অভিযানকালে তছনছ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সে রকম কিছু হওয়ার কথা নয়। তারপরও জাতভাইয়ের ওপর হামলা হয়েছে। তাই হয়তো।’