পুলিশের মারধরে ‘মাদক ব্যবসায়ীর’ মৃত্যু

প্রতীকী ছবি

রফিকুল ইসলাম বজ্রপাতে মারা গেছেন বলে একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানায়। পরে তা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। মাদক কেনাবেচার অভিযোগ রয়েছে—এমন কয়েক ব্যক্তিকে ওই মামলার আসামি করা হয়। এর মধ্যে এক আসামি গত শুক্রবার আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, রফিকুলের কাছ থেকে হেরোইন কেড়ে নিতে গিয়ে তাঁকে হত্যা করেন পুলিশের পাঁচ সদস্য। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট উজ্জ্বল মাহমুদের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন গোদাগাড়ী পৌরসভার মাদারপুর মহল্লার রেজাউল ইসলামের ছেলে ইসাহাক আলী ওরফে ইসা (২৮)। তিনি এলাকায় পুলিশের সোর্স ও মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।

নিহত রফিকুল ইসলামের (৩২) বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার পোলাডাঙ্গা গাইনাপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ফজলুর রহমান।

ইসাহাক আলী তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, গত মার্চে ৫০০ গ্রাম হেরোইনের একটি চালান সীমান্ত পার হয়ে আসে। ইসাহাক পুলিশের সঙ্গে চুক্তি করেন, হেরোইনের একটি চালান ধরিয়ে দেবেন। বিনিময়ে তাঁকে ২ লাখ টাকা দিতে হবে। রফিকুল ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের জামাল উদ্দিন (৩২) হেরোইন নিয়ে আসছিলেন। ২২ মার্চ রাতে ইসাহাক আলী গোদাগাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান, আবদুল মান্নান ও রেজাউল ইসলাম এবং কনস্টেবল শফিকুল ও শাহাদাতকে নিয়ে মাটিকাটা দেওয়ানপাড়া সিঁড়িঘাট এলাকায় যান। তাঁরা জামাল ও রফিকুলকে ৫০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক করেন। এ সময় পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে রফিকুলের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। মারধরের একপর্যায়ে রফিকুল মারা যান। ওই সময় ইসাহাক সেখান থেকে চলে আসেন। পুলিশ জামালকে ধরে নিয়ে যায় এবং চরের ওপর রফিকুলের লাশ ফেলে চলে আসে।

ইসাহাক আলীর জবানবন্দিতে পাঁচ পুলিশ সদস্যের নাম এসেছে। আদালত থেকে নথিপত্র পাওয়ার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জামাল উদ্দিন, এসআই, পিবিআই, রাজশাহী কার্যালয়

ইসাহাক আলী জবানবন্দিতে আরও বলেন, জামালকে ধরে এনে পুলিশ ১০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার দেখিয়ে একটি মামলা দেয়। বাকি ৪০০ গ্রাম হেরোইন পুলিশ আত্মসাৎ করে। পুলিশ পরে তাঁর ২ লাখ টাকাও দেয়নি। বজ্রপাতে রফিকুলের মৃত্যু হয়েছে বলে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করে পুলিশ। আর হেরোইন জব্দের ঘটনায় পুলিশ জামালের নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে।

পরে ১৭ জুন নিহত রফিকুলের স্ত্রী রুমিসা খাতুন বাদী হয়ে গোদাগাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলার আসামিরা হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আবদুল মালেকের ছেলে শরিফুল ইসলাম (৩২) ও একই এলাকার আজাদ আলীর ছেলে জামাল উদ্দিন (৩২)। শরিফুল এখনো পলাতক।

থানা-পুলিশের পর মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান পিবিআইয়ের রাজশাহী কার্যালয়ের এসআই জামাল উদ্দিন। তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইসাহাক আলীসহ তিনজনকে আটক করা হয়। অন্য দুজন হলেন গোদাগাড়ীর মাদারপুর মহল্লার আজিজুল ইসলামের ছেলে ফরিদুল ইসলাম (২৫) ও আজাদ আলীর ছেলে মাহাবুর আলী (৩১)। শুক্রবার সকালে তিনজনকেই ওই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়। আদালতে ইসাহাক আলীর জবানবন্দি গ্রহণ করা শেষ হলে তিনজনকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

এসআই জামাল উদ্দিন বলেন, ইসাহাক আলীর জবানবন্দিতে পাঁচ পুলিশ সদস্যের নাম এসেছে। আদালত থেকে নথিপত্র পাওয়ার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম বলেন, ওই হত্যাকাণ্ডে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত কি না, সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। ওসি জানান, প্রায় দুই বছর ধরে এসআই মিজানুর রহমান গোদাগাড়ী থানায় কর্মরত। মাস দুয়েক আগে জেলাজুড়ে বিতর্কিত পুলিশ সদস্যদের ‘বদলি অভিযান’ শুরু হলে এসআই মান্নান ও রেজাউল এবং কনস্টেবল শাহাদাতকে অন্যত্র বদলি করা হয়। কনস্টেবল শফিকুল গোদাগাড়ী থানায় আছেন। তিনি গাড়িচালক।

রফিকুলকে মারধর করে হত্যা এবং ৪০০ গ্রাম হেরোইন আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে গোদাগাড়ী থানার এসআই মিজানুর রহমান গতকাল শনিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের ওই সদস্যদের (রেজাউল, মান্নান, শাহাদাত ও শফিকুল) সঙ্গে তিনি চাকরি করেছেন। তিনি স্বীকার করেন, গত ২১ এপ্রিল রাতে তাঁরা অভিযান চালিয়ে জামালের কাছ থেকে ১০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে মামলা দিয়েছেন। বজ্রপাতে রফিকুলের মারা যাওয়ার তথ্যটি জামালই দিয়েছিলেন। আদালতে ১৬৪ ধারায় তাঁদের নাম আসার বিষয়টি শুনে তিনি বলেন, ওখানে এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তারপরও তাঁদের একটা ভালো বাহিনী পিবিআই তদন্ত করছে। তারা নিশ্চয়ই সত্য উদ্‌ঘাটন করবে—এটাই তিনি আশা করছেন।