পোকা দমনে জনপ্রিয় 'পার্চিং'

তিন বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন মো. জাকির হোসেন। তিনি খেতের মধ্যে ৪২টি বাঁশের কঞ্চি ও গাছের ডাল পুঁতে রেখেছেন। সেখানে পাখি এসে বসছে। খেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে।

খুলনা ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের এই কৃষক বলেন, পোকামাকড়ের হাত থেকে ধানের গাছ রক্ষা করতে চারা লাগানোর মাসখানেকের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যবধানে তিনি গাছের ডাল ও কঞ্চি পুঁতে রেখেছেন। পাখিগুলো ক্ষতিকর পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে। অন্যবার যেখানে তাঁকে তিন-চার দফা কীটনাশক ব্যবহার করতে হতো, এ বছর মাত্র একবার তিনি কীটনাশক ব্যবহার করেছেন।

জাকির হোসেনের মতো খুলনার বেশির ভাগ কৃষক পাখি বসার উপযোগী বাঁশের আগা, কঞ্চি, গাছের ডাল প্রভৃতি পুঁতে আমন খেতে ক্ষতিকর পোকা দমন করছেন। অনেক জমিতে মাঝেমধ্যে লাগিয়েছেন ধঞ্চেগাছ। এতে কৃষকেরা উপকার পাচ্ছেন। কীটনাশক কম লাগায় কৃষকেরা খুশি।

খেতের ক্ষতিকর পোকা দমনের ওই প্রাকৃতিক পদ্ধতির নাম ‘পার্চিং’। জেলার কৃষকদের কাছে এই পদ্ধতি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পার্চিং মানে খেতে ডালপালা পুঁতে দেওয়া। ফসলের জমিতে ডাল, কঞ্চি, বাঁশের খুঁটি এগুলো পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করলে পাখি ক্ষতিকারক পোকার মথ, বাচ্চা, ডিম খেয়ে পোকা দমন করে। মূলত ফিঙে, শালিক, বুলবুলি, শ্যামা, দোয়েল, সাত ভায়রা—এসব পাখি পার্চিংয়ে বসে পোকা ধরে খায়। ফসলের পোকা দমনের এ পদ্ধতি বলতে গেলে ব্যয়বিহীন ও পরিবেশবান্ধব। ফসলের খেতে ডেড পার্চিং ও লাইভ পার্চিং দুটিই করা যায়। মরা ডালপালা পুঁতে দিলে তা হবে ডেড পার্চিং। আর ধঞ্চে, অড়হর—এসব জীবন্ত গাছ জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে লাগিয়ে দেওয়া হলো লাইভ পার্চিং। প্রতি শতকে অন্তত একটি বাঁশের আগা, কঞ্চি বা ডাল পুঁততে হয়। ফসল রোপণের পরপরই পার্চিং স্থাপন করতে হয়। ফসলের সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে কমপক্ষে এক ফুট উচ্চতায় পার্চিং করা উচিত বলে তাঁরা জানান।

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পার্চিং পদ্ধতি জেলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে। আগে চাষিরা ধান লাগানোর পর বিলের মধ্যে গিয়ে পার্চিং করতে চাইতেন না। এই পদ্ধতি কৃষকদের উপকারে আসছে, খরচ বাঁচাচ্ছে বলে পার্চিংয়ের ব্যবহার বাড়ছে। আগে কৃষক ডেথ পার্চিং বেশি করতেন। এখন লাইভ পার্চিংয়েও আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ বছর এখনো আমন খেতে পার্চিং চলছে। জেলায় এ বছর ৯১ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। শতভাগ পার্চিয়ের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে ৬০ শতাংশ আমন খেতে পার্চিং হয়ে গেছে।

ডুমুরিয়া, দাকোপ, বটিয়াঘাটাসহ কয়েকটি অঞ্চলে আমন খেত ঘুরে দেখা গেছে, আমন খেতের মধ্যে কিছু দূর পরপর কৃষক বাঁশের আগা, কঞ্চি, গাছের ডাল প্রভৃতি পুঁতে দিয়েছেন। অনেকে এখনো ডাল পুঁতছেন। অনেক খেতে আলের পাশে এবং জমির মাঝখানে ধঞ্চে লাগানো হয়েছে। এসব পার্চিংয়ে ফিঙে, শালিক প্রভৃতি পাখি বসে থাকতেও দেখা গেছে।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, এ বছর ডুমুরিয়ায় ১৫ হাজার ২১৩ হেক্টর জমিতে আমন লাগানো হয়েছে। ৯০ শতাংশ জমি পার্চিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। ১০০ হেক্টরের মতো জমিতে লাইভ পার্চিং হয়েছে। লাইভ পার্চিংয়ে একদিকে পোকা দমন যেমন হয়, তেমনি এসব গাছের পাতা জমিতে পড়ে নাইট্রোজেন সারের মাত্রাও বাড়াচ্ছে। পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব পার্চিং পদ্ধতির পাশাপাশি আমন ফসলের খেতে পোকামাকড়ের উপস্থিতি যাচাইয়ের জন্য আরেক পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ‘আলোক ফাঁদ’ স্থাপন করা হচ্ছে।

দাকোপের চালনা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক জীবন মণ্ডল এবার চার বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন। তিনি সম্পূর্ণ খেতে পার্চিং করেছেন। তিনি বলেন, চার বিঘা জমির আমন ধানখেতে তিনি গাছের ৩০টি ছোট ডাল ও বাঁশের কঞ্চি পুঁতে দিয়েছেন। ফিঙে ও শালিক ওই ডালে বসে খেতের ক্ষতিকর পোকা, বিশেষ করে মাজরা পোকার মথ ধরে খেয়ে ফেলছে। এতে ভালো কাজ হচ্ছে, কীটনাশক ব্যবহার অনেক কমেছে। এ ছাড়া রাতে পার্চিংয়ে পেঁচা বসে খেতের ইঁদুর ধরছে। আলের ওপর প্রায় প্রতিদিনই পেঁচায় খাওয়া ইঁদুরের মাথা পাওয়া যাচ্ছে। ইঁদুর দমনে পার্চিং ব্যাপক কাজ করছে বলে মত দেন ওই এলাকার কৃষক মিহির মণ্ডল।

দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান বলেন, এবার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাকোপে ১৮ হাজার ৮২৫ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ ভাগ জমি পার্চিংয়ের আওতায় এসেছে। এখনো পার্চিংয়ের কাজ চলছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার বলেন, ক্ষতিকর পোকা দমনে পার্চিং পদ্ধতি খুব কার্যকর। এই পদ্ধতি কাজে লাগালে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যায়। উৎপাদন খরচ কমে। বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা যায়। প্রতিবছর একটু একটু পার্চিং বাড়ছে। এ বছর এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ জমি পার্চিংয়ের আওতায় এসেছে। কিছুদিনের মধ্যে সেটা শতভাগের কাছাকাছি যাবে।