প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতায় ভোগান্তি

সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সিলেটের একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে ১৭ নভেম্বর আগুন ধরে সিলেটসহ আশপাশের জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। এরপর সিলেট শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে প্রায় আড়াই দিন সময় লেগেছে। এখনো সেখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয়নি। এর আগে উপকেন্দ্রে আগুন লেগে ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়াতে বেশ কিছুদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। এর কারণ, পিজিসিবির পর্যাপ্ত উপকেন্দ্র নেই। একই এলাকায় বিকল্প উপকেন্দ্র থাকলে পরিস্থিতি এ রকম হতো না।

অথচ চার বছরের বেশি আগে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নিয়েছিল পিজিসিবি। এ প্রকল্পের কাজ শুরু হলে সারা দেশে সঞ্চালনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। জিটুজি বা সরকারি পদ্ধতিতে চীনের বেসরকারি দুটি কোম্পানি কাজটি পায়। কিন্তু গত চার বছরে কাজ শুরুই হয়নি। ফলে বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি। উপকেন্দ্রের অভাবে সঞ্চালনব্যবস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি না হওয়ায় সরকারের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

প্রকল্পটির বিষয় জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পটির কাজ বুঝে নিতে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রচলিত নিয়মকানুন মেনেই এ প্রকল্পের ঠিকাদারদের কাজ করতে হবে।’

পিজিসিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক স্ট্রেনদিং প্রজেক্ট’ নামের একটি প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। ১৪ হাজার ৩২৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ যৌথভাবে পায় চীনের বেসরকারি কোম্পানি সিসিসি ইঞ্জিনিয়ারিং (সিসিসিই) ও ইটার্ন। এ প্রকল্পের আওতায় ৯০টি প্যাকেজ রয়েছে। এর মধ্যে ৭৯টি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজ রয়েছে। সিলেটে নতুন বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণও ছিল এ প্রকল্পের আওতায়। ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত কোনো কাজ শুরুই হয়নি।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, দেশে এখন স্থাপিত বিদ্যুতের ক্ষমতা ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। অন্যদিকে দেশে দিন–রাত মিলিয়ে গড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। কারণ, পর্যাপ্ত সঞ্চালনব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নেই দেশে। এর ফলে কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দিতে হচ্ছে। গত ছয় বছরে শুধু কেন্দ্র ভাড়া বাবদই ৬৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অথচ রাজধানী ঢাকা ও বড় শহরগুলোর বাইরে এখনো সারা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন নয়। দিনে–রাতে একাধিকবার দেশের জেলা ও উপজেলায় বিদ্যুতের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। এর অন্যতম কারণ হলো সঞ্চালনব্যবস্থা পিছিয়ে থাকা।

পিজিসিবির কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশে সঞ্চালনব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য নেওয়া প্রকল্পে ঋণ আনার আশ্বাস দিয়েছিল সিসিসিই ও ইটার্ন যৌথ কোম্পানি। ঋণের ব্যবস্থা করবে, এই শর্তেই তাদের কাজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চীনা এক্সিম ব্যাংক থেকে তারা সময়মতো ঋণ আনতে ব্যর্থ হয়। এতে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। এর সঙ্গে রয়েছে নকশার ত্রুটিও।

প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যর্থতা ছাড়াও প্রকল্পের কাজ দুটি কোম্পানিকে নেওয়া নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলেন কর্মকর্তারা। পিজিসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, জিটুজি বা দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে যত প্রকল্প হয়, তা সরকারি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হয়। এরপরও ওই সব প্রকল্পে দরপত্র ডাকা হয়। যেমন রামপাল, মাতারবাড়ী ও পায়রা প্রকল্প জিটুজি ভিত্তিতে হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের ঠিকাদার কারা হবেন, সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে দরপত্রের মাধ্যমে। তবে ১৪ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।

এ বিষয়ে ১০ নভেম্বর পিজিসিবির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি বিশেষ কোম্পানিকে দেওয়ার জন্যই করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের যেসব নকশা জমা দিয়েছে ঠিকাদার, তাতে বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়েছে। সেসব এখন ঠিক করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০৩০ সালের আগে শেষ হবে না।

এতে সরকারের ক্রয়নীতির ব্যত্যয় হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’ এ বিষয়ে ৯ নভেম্বর সিসিসিই প্রেসিডেন্ট ইয়ান ওয়াইর কাছে ই–মেইলের মাধ্যমে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তবে তিনি কোনো জবাব দেননি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের যেসব নকশা জমা দিয়েছে ঠিকাদার, তাতে বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়েছে। সেসব এখন ঠিক করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০৩০ সালের আগে শেষ হবে না।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের। এ জন্য তারা প্রকল্পও নিয়েছিল। চীনা কোম্পানি সিসিসিই সেই প্রকল্পের কাজই শুরু করতে পারেনি। এ জন্য তাদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। এই কাজ বিনা দরপত্রে দুর্নীতি–অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা কাজ দিতে সহায়তা করেছেন, পিজিসিবির সেই সব ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।