প্রকৃতিতে ফিরল ৫৩ সুন্দি কচ্ছপ

বিশ্বঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদসংলগ্ন ঐতিহাসিক ঘোড়াদিঘিতে অবমুক্ত করা হচ্ছে ৫৩টি স্বাদুপানির সুন্দি কচ্ছপ। আজ বুধবার বিকেলেপ্রথম আলো

বলা চলে মৃত্যুর ক্ষণ গুনছিল নিরীহ এই প্রাণীগুলো। সুন্দি নামের স্বাদুপানির এই কচ্ছপগুলো বাজারে তোলা হয়েছিল বিক্রির জন্য। কেটে বিক্রিও হচ্ছিল গোপনে। খবর পেয়ে জীবিত ৫৩টি কচ্ছপ উদ্ধার করে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। উদ্ধার করা সুন্দি কচ্ছপগুলো আজ বুধবার ফিরিয়ে দেওয়া হলো প্রাকৃতিক পরিবেশে।

আজ বুধবার বিকেলে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদসংলগ্ন বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ঘোড়াদিঘিতে অবমুক্ত করা হয় উদ্ধার ৫৩টি কচ্ছপ। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলা বাজারের এক মুরগি ব্যবসায়ীর দোকান থেকে ক্রেতা সেজে কচ্ছপগুলো উদ্ধার করে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট (ডব্লিউসিসিইউ)।

সে সময় আটক বিক্রেতা নিরাপদ সরকারকে (৬৯) ভ্রাম্যমাণ আদালত ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে উদ্ধার কচ্ছপগুলো প্রকৃতিতে অবমুক্ত করার নির্দেশ দেন। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে মুরগির ব্যবসার আড়ালে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা কচ্ছপ বিক্রির সঙ্গে জড়িত বলে জানায় ডব্লিউসিসিইউ।

উদ্ধার সুন্দি কচ্ছপগুলো ফিরল প্রকৃতিতে। আজ বুধবার বিকেলে ষাটগম্বুজ মসজিদসংলগ্ন ঐতিহাসিক ঘোড়াদিঘির পাড়ে
প্রথম আলো

খুলনার বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) নির্মল কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের প্রাণী উদ্ধার ও পাচার রোধে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট কাজ করছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা বুধবার বটিয়াঘাটা উপজেলা বাজার থেকে ৫৩টি জীবিত কচ্ছপ উদ্ধার করি। বিভিন্ন সময়ই আমরা কচ্ছপ, অতিথি পাখি এবং বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির প্রাণী উদ্ধার করছি এবং এগুলো আবার প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে কাজ করছি। এই ধারাবাহিকতায় উদ্ধার কচ্ছপগুলোকে নিরাপদে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আমরা ঘোড়াদিঘিতে কচ্ছপগুলো উন্মুক্ত করলাম।’

আজ বিকেলে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদসংলগ্ন বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ঘোড়াদিঘিতে অবমুক্ত করা হয় উদ্ধার ৫৩টি বিপন্ন সুন্দি কচ্ছপ।

নির্মল পাল বলেন, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ এলাকা ওয়েটল্যান্ড, অর্থাৎ জলাভূমি বেশি। এখানে আগে থেকেই প্রাকৃতিকভাবে কচ্ছপ ছিল। তবে বিগত দিনগুলোতে যথেচ্ছ শিকারের কারণে এখন এগুলোর সংখ্যা কমে গেছে। বন্য প্রাণী আইন অনুযায়ী এগুলো শিকার সম্পূর্ণ নিষেধ। এই ঐতিহাসিক দিঘিগুলোতে যেমন কচ্ছপগুলো রক্ষা হবে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ হবে, একই সঙ্গে এখানে আসা দর্শনার্থীদের বিনোদনেরও একটা সুযোগ হবে।

কচ্ছপগুলো দিঘির পানিতে ছাড়ার পর বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক আ ন ম ফয়জুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই কচ্ছপগুলো এখানে ছাড়ার মাধ্যমে প্রকৃতিতে এগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা একটি বার্তা দিতে চেয়েছি। সুন্দরবন–সংশ্লিষ্ট অঞ্চল হিসেবে এখানে যেন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত থাকে, এ জন্য আমরা সব সময় সোচ্চার থাকব। বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমরা কাজ করে যাব।’

এভাবেই পানিতে ছাড়া হলো বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের উদ্ধার করা ৫৩টি সুন্দি কচ্ছপ। আজ বুধবার বিকেলে ষাটগম্বুজ মসজিদসংলগ্ন ঐতিহাসিক ঘোড়াদিঘিতে
প্রথম আলো

ষাটগম্বুজ মসজিদসংলগ্ন বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ প্রথম আলোকে বলেন, ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদের পাশের এই ঘোড়াদিঘিতে বন বিভাগ যে সুন্দি কচ্ছপগুলো অবমুক্ত করেছে, তা একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্য রক্ষা করবে; একই সঙ্গে দর্শনার্থীদের আগ্রহেও নতুন মাত্রা যোগ করবে। আমরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও বাগেরহাট জাদুঘরের পক্ষ থেকে এগুলো দেখভালের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।’

এর আগে সপ্তাহ আগে ৬ জানুয়ারি বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার মাছবাজার থেকেও ৩৯টি কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় চাহিদার কারণে এ অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামীণ হাটবাজারে দীর্ঘদিন ধরে কেটে কচ্ছপ বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি পাচারও হচ্ছে প্রচুর। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ভারতে পাচারকালে খুলনা থেকে ৪৯৪টি কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়েছিল।

নোনাপানিতে সুন্দি কচ্ছপের দেখা পাওয়া যায় না। এর ইংরেজি নাম Indian flapshell turtle, বৈজ্ঞানিক নাম ‘Lissemys punctata’। আগে দেশের সব জলাশয়ে সুন্দি কচ্ছপ দেখা গেলেও এখন এর সংখ্যা কম। শুকনো মৌসুমে মাছ ধরার জন্য খালবিল, হাওর-বাঁওড় সেচ করলেই দেখা মিলত এদের। বর্তমানে আবাসস্থল ধ্বংস, অবৈধ শিকার ও জলাশয় দূষণের কারণে বিপন্ন হচ্ছে প্রাণীটি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-২ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, পাকিস্তান, ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাতেও আছে সুন্দি কচ্ছপ। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত এদের প্রজনন মৌসুম। মিঠাপানির কচ্ছপ হওয়ায় ডিম দিতে ওই সময়ে ডাঙায় উঠে এরা। তাদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ উদ্ভিদ ও ছোট ছোট প্রাণী।