প্রতিটি বাড়িতেই সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ হতো

গোলাম ফারুক

কুমিল্লা শহরের তালপুকুর এলাকায় আমার শৈশব, কৈশোর ও বর্তমান সময় কাটছে। এখানকার সিংহবাড়িতেই আমার বেড়ে ওঠা। আমাদের বাড়িটি ছিল সিংহ পরিবারের বাংলো বাড়ি। সিলেটি (আসাম) প্যাটার্নে ভিটা পাকা টিনের ঘর। চারদিকে বাঁশের বেড়া। টিনের চালের তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল বাঁশের সিলিং। দক্ষিণমুখী ঘর। সুন্দর বৈঠকখানা। বাড়ির আশপাশে সুপারিবাগান আর বিস্তীর্ণ মাঠ ছিল। পুরো বাড়িতে ছিল সাংস্কৃতিক আবহ।

এই বাড়িতে আমরা আসার আগে (১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে) উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আয়েত আলী খাঁ, হোসেন খসরু, গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য ও সুরকার হিমাংশু দত্তের আনাগোনা ছিল। পাকিস্তান আমলে ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কামিনী কুমার দত্ত, শহীদ অতীন্দ্র ভদ্র, বিপ্লবী অতিন রায়, ভাষাসৈনিক অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ ও সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারকে এই বাড়িতে আসা–যাওয়া করতে দেখেছি। বাড়ির পাশে সাংবাদিক রজনীনাথ নন্দীর বাড়ি। এর পাশেই থাকতেন শান্তি নিকেতনের শিক্ষার্থী সুধীর সেনের সহধর্মিণী সুধা সেন। এ রকম প্রাজ্ঞ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের এলাকায় আমার বেড়ে ওঠা।

আমাদের শৈশবে ঘুম ভাঙার পর কানে ভেসে আসত এ বাড়ি–ও বাড়ি থেকে গানের সুর। হারমোনিয়ামের শব্দ। প্রতিটি বাড়িতে গানের রেওয়াজ হতো। এখন তা কমে গেছে। আগে কুমিল্লা টাউন হলে নাটকসহ নানা ধরনের উত্সব ও অনুষ্ঠান লেগে থাকত। এখন সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ কমে এসেছে।

আমাদের এলাকায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দ চন্দ্র রায়ের বাড়ি, নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে শহীদ ভদ্রের বাড়ি, এর একটু দক্ষিণে বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের বাবা কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক দ্বিজদাস দত্তের দোতলা বাড়ি ছিল। তখনকার সময়ে বাড়িগুলোর বেশির ভাগই ছিল টিন ও বাঁশের বেড়ার। খোলামেলা বাড়ি। এখনো সিংহবাড়ির শান্তি কুটির ভবন আছে। নগরের ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলোর মধ্যে রায়বাড়ি, মুখার্জিবাড়ি, কৈলাস ভবন, মোহিনী মোহন বর্ধনের বাড়ি, গুহবাড়ি, মহেশ ভট্টাচার্যের বাড়ি, শচীন দেববর্মনের বাড়ি, কুমারবাড়ি, রাজবাড়ি কম্পাউন্ড, নওয়াববাড়ি, দারোগাবাড়ি, মুন্সেফবাড়ি, ডেলনি হাউস। কুমিল্লা জজ কোটে পুরোনো ভবনটি পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গড়া।

এখন কুমিল্লা শহরের বেশির ভাগ বাড়ি মধ্যে উঁচু দালান গড়ে উঠেছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের স্থাপনা। এসব দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এত সুন্দর শহরে কত বিপ্লবী, প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি–সাহিত্যিক বসবাস করেছেন। তাঁদের স্মৃতির শহরে সড়কের ওপর গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। মানুষগুলো উঁচু ভবনের খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকে। প্রেক্ষাগৃহগুলোও বিলুপ্ত হয়ে গেছে (একটি ছাড়া)। দার্শনিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে শহরের সাংস্কৃতিক পরিবেশটাও সুন্দর করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে অতীত ঐতিহ্য।