প্রতিষ্ঠানে এসেই বদলে যায় জীবনের গল্প

ভৈরবের হাজী আসমত আলী এতিম বালিকা পরিবারের নারীরা নিয়মিত খেলাধুলায়ও অংশ নেয়। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা
প্রথম আলো

ইতির বাবা আবদুল হক মারা যান ২০০৭ সালে। টানাপোড়েনের সংসারে তাঁর পরিবারে অভাবটা তখন স্থায়ী হয়ে যায়। আর্থিক দৈন্যে একে একে বন্ধ হয়ে যায় সব ভাইবোনের পড়াশোনাও। অবশেষে ২০১২ সাল থেকে আরও এক বোনসহ ইতির ঠিকানা হয় কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শহরের চণ্ডীবের এলাকায় অবস্থিত হাজী আসমত আলী এতিম বালিকা পরিবারে।

হাজী আসমত আলী এতিম বালিকা পরিবারে গিয়ে আবার সচল হয় ইতিসহ তার বোনের পড়াশোনা। অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০১৭ সালের ৫ মে ইতি যোগ দেন পুলিশ বাহিনীতে। ইতি এখন গাজীপুর পুলিশ লাইনসে কনস্টেবল পদে কর্মরত রয়েছেন।
ইতির আয়ে পরিবারটির অন্য সদস্যরা এখন সমাজে টিকে রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতির মতো কয়েক শ নারী এখন জীবনের অসহায়ত্ব ঘুচিয়ে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। এতে এসব অসহায় নারী পরিবারে যেমন আর্থিক নিরাপত্তা বেড়েছে, তেমনি বাবা বা মা হারানো অসহায় এসব নারী ভেঙে পড়া মনে ফিরে পেয়েছে আত্মবিশ্বাস। আর ১০ বছর ধরে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করছে হাজী আসমত আলী এতিম বালিকা পরিবার নামে ওই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।

প্রতীকী ছবি

এই প্রতিষ্ঠানে থেকে নারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি নানা দপ্তরে চাকরি করছেন। কেউ নিচ্ছেন উচ্চশিক্ষা। ইতি বলেন, ‘একটি সময় পরিবারের আর্থিক সমস্যা এত বড় হয়ে উঠেছিল যে দুবেলা খাওয়ার চিন্তা করা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারতাম না। হাজী আসমত আলী এতিম বালিকা পরিবারে আসার পর অন্তত আমাদের দুই বোনের থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ হয়।’

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অসহায় নারীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার ভাবনা থেকে স্থানীয় কয়েকজন সমাজকর্মী ওই বালিকা পরিবার প্রতিষ্ঠা করেন। দানবীর হাজী আসমত আলীর দেওয়া ২০ শতাংশ জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে ৮০০ নারীর আবাসন ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছয়তলাবিশিষ্ট একটি ভবনে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় তারা বেড়ে উঠছে। এসব নারীর পড়াশোনা, প্রযুক্তিজ্ঞান, চিকিৎসাসেবা, খাওয়া—বিনে পয়সায় সবই মিলছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। শুধু তা-ই নয়, নির্দিষ্ট সময়ের পর নারীরা যেন কর্মক্ষেত্রে যোগ্য হয়ে উঠতে পারে, সেই কারণে নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রতিষ্ঠানে থাকা নারীরা যেন নিজেদের প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারে, সেই কারণে লাগোয়া স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে হাজী আসমত আলী বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ। চিকিৎসার জন্য করা হয়েছে হাজী আসমত আলী মেডিকেল সেন্টার। স্কুলটিতে এখন পড়াশোনা করছে ৫০০ শিক্ষার্থী। তবে এখনো কলেজটির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠানের নারীরা অন্য একটি কলেজে পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে।

আর্থিক জোগানের একটি অংশ আসে স্থানীয় সহযোগিতায়। বড় একটি অংশের ব্যয় মেটানো হচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা কাতার চ্যারিটি এবং নভেল অর্গানাইজেশন ফর রুরাল রিফর্মস নামে একটি দাতা সংস্থার মাধ্যমে।

ভৈরব হাজী আসমত আলী এতিম বালিকা পরিবারের নারীরা পাঠাগারে সংবাদপত্র পড়ছে
প্রথম আলো

বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের তিন নারী ঢাকার প্রাইম নার্সিং কলেজে নার্সিং বিভাগে পড়াশোনা করছেন। তাঁরা হলেন জুয়েনা আক্তার, অর্পা ইসলাম ও হেনানুর বেগম। কথা হয় জুয়েনার সঙ্গে। ২০০৬ সালে জুয়েনার বাবা সাফির উদ্দিন মারা যান। পরে সংসারের অভাব দূর করতে জুয়েনার ঠিকানা হয় ওই বালিকা পরিবারে। জুয়েনা বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে কীভাবে একজন অসহায় মানুষের জীবনের গল্প বদলে যেতে পারে, এই বালিকা পরিবারে ঠাঁই না হলে বোঝার সুযোগ ছিল না। একটি প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে এখন আমি সুখের স্বপ্ন দেখতে পারছি।’

রোববার গিয়ে দেখা যায়, বালিকা পরিবারের ছয়তলাবিশিষ্ট সুউচ্চ ভবনের সামনে বিশাল মাঠ। প্রধান ফটকের সামনে ফুলের বাগান। চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে একটি মিলনায়তন। আছে কম্পিউটার ল্যাব কক্ষ। থাকার কক্ষগুলো পরিপাটি। প্রতিটি কক্ষে আছে প্রয়োজনীয় আসবাব। আছে একটি পাঠাগারও।

প্রতিষ্ঠানটি থেকে জানানো হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে এখন ১০ জন উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। তাঁদের মধ্যে কথা হয় রাইসা আক্তারের সঙ্গে। রাইসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। উপজেলার কালিকাপ্রসাদ গ্রামের বাসিন্দা রাইসার বাবা আফসার উদ্দিন মারা যান ২০০৬ সালে। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে রাইসার ঠাঁই হয় এই বালিকা পরিবারে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে খেয়ে বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।
রাইসা বলেন, ‘বাবাকে হারানোর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব দূরের কথা, নাম জানার সুযোগ ছিল না। এই সুযোগটির শতভাগ কৃতিত্ব এই বালিকা পরিবারের।’

বছরের পর বছর ধরে অসহায় নারীদের থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা সর্বোপরি কর্মের ব্যবস্থা করতে পারায় বেশ উজ্জীবিত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ ও দাতা সংস্থার সদস্যরা। সামনে থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পরিচালন পরিষদ সভাপতি পৌর মেয়র ইফতেখার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সাবেক পৌর কাউন্সিলর মাহিন সিদ্দিকী এবং নভেল অর্গানাইজেশনের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ।

কথা হয় মাহিন সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এতিম বা অসহায় নারীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা কঠিন নয়। কঠিন হলো তাঁদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া এবং আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। স্থানীয় এবং দাতা সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জগুলো খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করতে পারছি। বাড়তি সুখ তাতেই।’