প্রবাস থেকে ফিরে সবুজ মাল্টায় রহমানের সুদিন

সবুজ মাল্টাবাগানে আবদুর রহমান। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চিনাকান্দি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

দুই দশক প্রবাসে দরজির কাজ করে দেশে সংসার চালিয়েছেন। একসময় আয় কমে আসে। বিপাকে পড়েন মোহাম্মদ আবদুর রহমান (৫৫)। শুরু হয় দেশে ফেরার চিন্তা। কিন্তু কী করবেন, এ ভাবনা পেয়ে বসে। একদিন ইউটিউবে পিরোজপুরের এক মাল্টাচাষির প্রতিবেদন চোখে পড়ে। শুরু হয় ইন্টারনেট, ইউটিউবে ঘাঁটাঘাঁটি। সব দেখে সিদ্ধান্ত নেন মাল্টা চাষের। দেশে এসে করেন ‘গ্রিন মাল্টার’ বাগান।

আবদুর রহমানের বাড়ি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চিনাকান্দি গ্রামে। প্রবাস থেকে ফিরে গ্রিন মাল্টার চাষ করে সুদিনের দেখা পেয়েছেন তিনি। শুধু মাল্টা নয়, একই বাগানে তিনি করছেন মৌসুমি বিভিন্ন জাতের সবজির চাষ। রয়েছে গরু ও ছাগলের খামার। সব মিলিয়ে ভালোই আয় হচ্ছে তাঁর। তাঁকে দেখে মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন এলাকার অন্যরাও।

আবদুর রহমান ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফেরেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। আবদুর রহমান জানান, দেশে ফিরে মাল্টা চাষের বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে তাঁকে বেশ উৎসাহ দেওয়া হয়। পরে তিনি গ্রামে থাকা তাঁর ৫০ শতক জমি মাটি ভরাট করে মাল্টা চাষের উপযোগী করেন। চারদিকে দেওয়া হয় নিরাপত্তাবেষ্টনী। কৃষি কার্যালয় এটিকে তাদের প্রদর্শনী প্লট করতে উদ্যোগ নেয়।

একপর্যায়ে আবদুর রহমানকে দেওয়া হয় মাল্টার চারা। বাগান তৈরিতে পরামর্শসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেন কৃষি কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামছুল আলম। আবদুর রহমান শুরু করেন গাছ লাগানো। প্রথম বছর গাছে ছোট ছোট ফল আসে। এরপরও তিনি প্রায় দুই লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করেছেন। তবে এবার বিক্রি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন রহমান।

সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থাকা সবুজ মাল্টা দেখলে মনে হবে কাঁচা। আসলে এগুলো সবুজ, মিষ্টি ও রসাল হয়
ছবি: প্রথম আলো

চিনাকান্দি গ্রামটি ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। সরেজমিনে দেখা যায়, এই এলাকার জমি এমনিতেই তুলনামূলক উঁচু। মাটি ফেলে আরও উঁচু করে তাতেই মাল্টার বাগান করা হয়েছে। সেখানে পানি জমে থাকে না। সারা দিনই রোদ থাকে। ছোট ছোট গাছে থোকা থোকা মাল্টা ঝুলে আছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থাকা সবুজ মাল্টা দেখলে মনে হবে কাঁচা। আসলে এগুলো সবুজ, মিষ্টি ও রসাল হয়। তবে দু–একটির রং কিছুটা হলুদ হয়। একেকটি গাছে বর্তমানে ৫ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত মাল্টা ধরেছে। আগামী বছর সেটা বেড়ে ৩০ কেজি পর্যন্ত হবে। এখন বাগানেই মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি দরে। আশা করছেন, ১৪০টি গাছ থেকে এ বছর ৩ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করতে পারবেন। আগামী বছর বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ছয় লাখ টাকায়।

বাগান পরিচর্যার জন্য সার্বক্ষণিক এক কর্মী আছেন। এ ছাড়া রহমান নিজেও কাজ করেন। পাশাপাশি অস্থায়ী আছেন আরও দুজন। বাগানের স্থায়ী কর্মী জসিম উদ্দিন (৫০) জানান, তিনি শুরু থেকেই আছেন। এর আগে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে একটি মাল্টার বাগানে কাজ করেছেন। আগের অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগিয়েছেন এখানে।

বাগানেই কথা হয় গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামের (২৫) সঙ্গে। তিনিও একটি মাল্টার বাগান করার চিন্তা করছেন। সিরাজুল বলেন, ‘রহমান ভাইয়ের বাগান দেখেই মূলত উৎসাহ পেয়েছি। কৃষি বিভাগের সঙ্গেও কথা বলেছি। আগামী বছর নিজের জমিতে বাগানের কাজ শুরু কবর।’

দেশে এসে কী করব, এ নিয়ে আমি খুবই চিন্তায় ছিলাম। মাল্টার বাগান আমাকে বদলে দিয়েছে। এই বাগানের সঙ্গে সবজি ও পশুর খামার করে দেশেই বিদেশের টাকা আয় করা সম্ভব।
আবদুর রহমান, মাল্টাচাষি

গ্রামের কলেজছাত্র রিয়াজুল ইসলাম বলেন, এলাকায় এটিই প্রথম মাল্টা চাষ। আবদুর রহমানকে দেখে এলাকার আরেকটি গ্রামে ছোট করে একটি বাগান করেছেন একজন। আরও অনেকে বাগান করার চিন্তা করছেন।

বাগানটি করতে আবদুর রহমানের খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা। এখন তিনি মৌসুমি সবজি হিসেবে বাগানে শসা, ঢ্যাঁড়স, মরিচ, টমেটো, লাউয়ের চাষ করছেন। এ থেকেও বাড়তি লাভ পাচ্ছেন। বাড়িতে ৭টি গরু ও ২০টি ছাগল নিয়ে আরেকটি খামার করেছেন।

আবদুর রহমান বলেন, ‘দেশে এসে কী করব, এ নিয়ে আমি খুবই চিন্তায় ছিলাম। মাল্টার বাগান আমাকে বদলে দিয়েছে। এই বাগানের সঙ্গে সবজি ও পশুর খামার করে দেশেই বিদেশের টাকা আয় করা সম্ভব। আমাকে দেখে এলাকার আরও লোকজন মাল্টার বাগান ও সবজি চাষে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। আমি সবাইকে পরার্মশ দিই।’

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামছুল আলম বলেন, আবদুর রহমান একজন পরিশ্রমী মানুষ। তিনি শুরু থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। যে কারণে এখন তিনি সুফল পেতে শুরু করেছেন। অন্যরাও তাঁকে দেখে উৎসাহ পাচ্ছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ নয়ন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর আগে আবদুর রহমানের আগ্রহ দেখে তাঁকে বারি মাল্টা-১ জাতের চারা দেওয়া হয়। এরপর তিনি কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় বাগান করেন। এখন বাগান থেকে তিনি মাল্টা বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। অন্যরা চাইলেও সব রকম সহযোগিতা পাবেন।