ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় উদ্বেগ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের

সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা। আজ দুপুরে পৌর শহরের একটি পত্রিকা কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

নির্ধারিত সময়ে সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা। আজ বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা উদ্বেগের কথা জানান। তাঁরা বলছেন, সময় চলে যাচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হবে। এ অবস্থায় ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় হাওরের ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষকেরা।

বাঁধ নির্মাণ নিয়ে সংগঠনটির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতেই পৌর শহরের একটি পত্রিকা কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংগঠনটির জেলা সভাপতি ও ছাতক উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অলিউর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে লিখিত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক। হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজের সময়সীমা ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পরে সেটি আরও ১০ দিন বাড়ানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নিজেদের গাফিলতি ও অনিয়ম ঢাকতে মনগড়া হিসাব দেয়। বিগত বছরের মতো এবারও বিভিন্ন স্থানে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প চিহ্নিত করেছে হাওর বাঁচাও আন্দোলন। সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও দুর্নীতির কারণেই কাজে বিলম্ব হচ্ছে। এ জন্য ফসলের কোনো ক্ষতি হলে তার দায় পাউবো ও প্রশাসনকে নিতে হবে। কৃষকদের পক্ষে হাওর বাঁচাও আন্দোলন আইনি পদক্ষেপ নেবে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, শাল্লা উপজেলায় ফসল রক্ষা বাঁধ প্রকল্প গ্রহণে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় বাহারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। উপজেলার ৩ নম্বর ভান্ডাবিল হাওর উপপ্রকল্পে ২৭৩ মিটার কাজের অধিকাংশই অক্ষত ছিল। কিন্তু সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। অভিযোগ আছে, কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তদারক কমিটির পছন্দের মানুষ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সভাপতি শান্ত কুমার দাস, সদস্যসচিব বকুল আহমদ ও সদস্য আনিছুল ইসলাম চৌধুরী। কৃষকেরা জানান, তাঁরা তিনজন কৃষক নন এবং হাওরে তাঁদের কোনো জমি নেই।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শাল্লা উপজেলার ৯ নম্বর প্রকল্পে এখনো মাটির কাজ চলছে। এ ছাড়া ১৮, ১৯, ২৩, ২৮, ৩৫, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ১২৮, ১২৯ ও ১৩০ নম্বর প্রকল্পের কাজ নিয়েও ব্যাপক অভিযোগ আছে। তাহিরপুর উপজেলার ৬৩ নম্বর প্রকল্পে কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তদারক কমিটির সঙ্গে আঁতাত করে কাউকান্দি গ্রামের আইন উদ্দিন তাঁর বাবার নাম পাল্টে প্রকল্পের সভাপতি হয়েছেন। একই উপজেলার ৬৩ ও ৬৪ নম্বর প্রকল্পের মাটির কাজ শেষ হয়নি। অধিকাংশ বাঁধে মাটির কাজ শেষ হলেও সেখানে দুরমুশ করা হচ্ছে না। এ ছাড়া ঢাল ঠিক করা ও ঘাস লাগানোর কাজ হচ্ছে না। এ অবস্থায় বৃষ্টি নামলে বাঁধ ধসে যেতে পারে। জামালগঞ্জ উপজেলার ৭ ও ৮ নম্বর প্রকল্পে এখনো মাটির কাজ চলমান। মহালিয়া, মুচিবাড়ির খাল ও বগলাখালী ক্লোজারে মাটির কাজ শেষ হলেও অন্যান্য কাজ হচ্ছে না। দিরাই উপজেলার ৭৯ প্রকল্পে মাটির কাজ শেষ হয়নি। অধিকাংশ বাঁধে এলোপাতাড়ি মাটি ফেলে রাখা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ১৪ মার্চ কুলঞ্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন বাঁধ পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মাটির কাজ শেষে অন্যান্য কাজ করছেন প্রকল্পের সদস্যরা। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ১ নম্বর প্রকল্পে এখনো মাটির কাজ চলছে। ২ ও ৩ নম্বর প্রকল্পে মাটির কাজ করা হয়েছে। বাকি কাজ করা হচ্ছে না। ২৭ নম্বর প্রকল্পে বালু দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। আশপাশে মাটি থাকলেও টাকার বিনিময়ে গ্রামে পুকুর খনন করে বালু এনে বাঁধ তৈরি করা হয়। মিয়ারচর যাদুকাটা নদীতীরের ক্লোজারে এখনো কাজ শেষ হয়নি।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, শান্তিগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর প্রকল্পের ৭৭৫ মিটার কাজে বরাদ্দ ছিল ১৯ লাখ ৯৬ লাখ। এ প্রকল্পে ৩৩০ মিটার কাজ হলেও বরাদ্দ একই পরিমাণে রাখা হয়েছে। ৪২-৪৯ নম্বর প্রকল্পে অধিকাংশ জায়গায় অক্ষত বাঁধে ওপরের ঘাস পরিষ্কার করে মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে। দূর থেকে দেখে নতুন বাঁধ মনে হলেও সেখানে শুভংকরের ফাঁকি। একইভাবে জামখলার হাওরের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। কাঁচিভাঙ্গা হাওরের ৯, সাংহাই হাওরের ১৩, খাই হাওরের ২৪, কাওয়াজুরি হাওরের ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ প্রকল্পে নীতিমালা অনুযায়ী কাজ হয়নি। শুধু টাকা তুলতে দায়সার কাজ করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ১৮ ও ১৯ নম্বর প্রকল্পে এখনো কাজ চলছে। উপজেলার সুরমা ইউনিয়নে কিছু বাঁধের কাজ চলছে, যেগুলো হাওর রক্ষায় কোনো কাজে আসবে না। তবে এলাকার মানুষ চলাচলের রাস্তা পাবে। ছাতক উপজেলার ৩, ৪ ও ১০ নম্বর প্রকল্পে এখনো মাটির কাজ চলছে। ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর প্রকল্পে এলোপাতাড়ি মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। দুরমুশ করাও হয়নি।

হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের অগ্রগতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা। আজ দুপুরে পৌর শহরের একটি পত্রিকা কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে কুদরত পাশা, প্রচার সম্পাদক আনোয়ারুল হক, জেলা সহসভাপতি আলী হায়দার ও চন্দন রায় বক্তব্য দেন।

সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে এবার জেলার ১১টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে ৭২৪টি প্রকল্পে ৫২০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ চলছে। এর জন্য প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর বিভাগ-১) ও হাওরে বাঁধ নির্মাণ-সংক্রান্ত জেলা কমিটির সদস্যসচিব মো. জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধের কাজ প্রায় শেষ। এখন আনুষঙ্গিক কাজ হচ্ছে। কাজে কোনো গাফিলতি বা অনিয়ম হয়নি। কাজ নীতিমালা অনুযায়ী হচ্ছে।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, এবার জেলায় ১ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। মাঠের অবস্থা ভালো। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে ভালো ফলনের আশা করছেন তাঁরা।