ফুল ভাসিয়ে পাহাড়ে সামাজিক উৎসবের শুরু

পুরোনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ফুল ভাসিয়ে দিচ্ছেন চাকমা সম্প্রদায়ের তিন নারী–পুরুষ। আজ সকালে রাঙামাটির রাঙ্গাপানি গ্রামের হাধাংজি বিলেছবি: সুপ্রিয় চাকমা

চাকমাদের পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পাহাড়ে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু ও সংক্রান উৎসব। আজ মঙ্গলবার সকালে রাঙামাটি শহরের রাজবন বিহার ঘাটসহ কাপ্তাই হ্রদের বিভিন্ন অংশে দল বেঁধে মানুষ ফুল ভাসিয়ে দেন। এ ছাড়া বাঘাইছড়ি সদর, করেঙ্গাতলী, লংগদুসহ বিভিন্ন উপজেলা শহর ও গ্রামে নদী-ছড়াগুলোতেও মানুষ ফুল ভাসিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানান।

সকাল সাড়ে ছয়টায় বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু ও সংক্রান উদ্‌যাপন কমিটির উদ্যোগে ফুল ভাসানো উৎসব আয়োজন করা হয়। শহরের কাপ্তাই হ্রদের অংশ রাজবন বিহার ঘাটে আয়োজিত ফুল ভাসানো উৎসবে উপস্থিত ছিলেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মামুন, জেলা পরিষদের সদস্য ঝরনা খীসা, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু ও সংক্রান উৎসব উদ্‌যাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, ইন্টু মনি চাকমা প্রমুখ।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্প্রদায় ভেদে এই উৎসবের ভিন্ন নাম রয়েছে। চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু ও চাক, ম্রো, খিয়াং ও খুমিরা সংক্রান নামে উৎসবটি পালন করে।

সকালে ফুল ভাসানো উৎসবে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকা থেকে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ ফুল নিয়ে রাজবন বিহার ঘাটে এসেছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুল ভাসানো উৎসব জমে ওঠে। এ সময় কলা পাতায় ফুল রেখে নতুন বছরে সুখ–শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন অনেকে।

এদিকে বাঘাইছড়ি উপজেলা করেঙ্গতলী ইউনিয়নে করেঙ্গাতলী উপজাতি কাঠ ব্যবসায়ী ও জোত মালিক সমিতির উদ্যোগে ফুল ভাসানো উৎসবের আয়োজন করা হয়। আজ সকাল নয়টার দিয়ে কাট্টলী বালুঘাট এলাকায় শতাধিক নারী-পুরুষ কাচালং নদীতে ফুল ভাসান। এ সময় সেখানে বঙ্গলতলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জ্ঞান জ্যোতি চাকমা, হেডম্যান বিশ্বজিৎ চাকমা, করেঙ্গাতলী উপজাতীয় কাঠ ব্যবসায়ী ও জোত মালিক সমিতির সভাপতি উদয়ন চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক নীতিশ চাকমা উপস্থিত ছিলেন।

ফুল ভাসানো উৎসবে অংশ নিতে এসেছে একটি পরিবার
ছবি: প্রথম আলো

পাহাড়ে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু ও সংক্রান সম্প্রদায় ভেদে পাঁচ থেকে সাত দিন ধরে এই উৎসব চলবে। ইতিমধ্যে উৎসবকে ঘিরে মেলা, ঐতিহ্যবাহী খেলা ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।

কাল বুধবার চাকমাদের মূল বিজু অতিথি আপ্যায়ন চলবে। অতিথিদের খাবারে মূল আকর্ষণ থাকবে পাজন (পাচন)। ২০ থেকে ৪০ প্রকারের সবজি মিশিয়ে পাজন রান্না করা হয়। আগামী বৃহস্পতিবার শেষ দিনে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পূজা–অর্চনা করা হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্প্রদায় ভেদে এই উৎসবের ভিন্ন নাম রয়েছে। চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু ও চাক, ম্রো, খিয়াং ও খুমিরা সংক্রান নামে উৎসবটি পালন করে। সমতলের লোকজনদের কাছে উৎসবটি বৈসাবি নামে পরিচিত। তবে বৈসাবি শব্দ দিয়ে পাহাড়ের চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা—এ তিন সম্প্রদায়ের উৎসবকে বোঝায়। এ কারণে অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনের উৎসবের কথা বাদ পড়ে যায়।

ফুল বিজুর আগে ফুল সাজানোর প্রস্তুতি চলছে
ছবি: প্রথম আলো

কাল থেকে ত্রিপুরাদের উৎসব শুরু হবে। উৎসবের প্রথম দিনে দল বেঁধে পিঠা তৈরি ও গরাইয়া নৃত্য, দ্বিতীয় দিনে অতিথি আপ্যায়ন ও তৃতীয় দিনে বৃদ্ধদের গোসল করানো হবে। ১৪ এপ্রিল থেকে মারমাদের উৎসব শুরু হবে। চলবে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত। উৎসবের প্রথম দিনে ফুল ভাসানো ও বাড়ি সাজানো হবে। দ্বিতীয় দিনে অতিথি আপ্যায়ন, তৃতীয় দিনে পানি উৎসব ও চতুর্থ দিনে বর্ষবরণ।

শুক্রবার থেকে ম্রো, খুমি, খিয়াং, চাক ও বমসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর উৎসব শুরু হবে। ম্রোরা শুক্রবার ফুল সংগ্রহ করবে। ওই দিন ছড়া থেকে মাছ ও চিংড়ি ধরে উৎসব আয়োজন করা হবে। তৃতীয় দিনে সব বয়সের মানুষ পূজা-অর্চনা করেন। এ ছাড়া শুক্রবার থেকে চাক, খিয়াং, খুমি ও বমরা বাড়িঘর সাজানো, অতিথি আপ্যায়ন ও দল বেঁধে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বুদ্ধমূর্তিকে চন্দনের পানি দিয়ে স্নান করানোর উৎসব আয়োজন করা হয়।

রাজবন বিহার ঘাটে আসা তরুণী শিপ্রা চাকমা ও দীপ্তি চাকমা বলেন, ‘বছর একবার আমাদের এই উৎসব হয়। করোনার কারণে গত দুই বছর উৎসব করা যায়নি। সেজন্য এবার মন খুলে আনন্দ করব। ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে আমাদের উৎসব শুরু হলো।’

উৎসব উদ্‌যাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টুমুনি তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন দিন ধরে ঐতিহ্যবাহী উৎসব ও খেলাধুলা আয়োজিত হচ্ছে। আজ ফুল ভাসানোর উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্যায়ের উৎসব শেষ হলো। কাল অতিথি আপ্যায়ন ও পরদিন পূজা–অর্চনা করা হবে।