ফেরি করে পানির দরে দুধ বিক্রি

এক খামারিকে ভ্যানে দুধ নিয়ে ফেরি করে বিক্রির জন্য নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। শুক্রবার বেড়া বাজার থেকে তোলা
প্রথম আলো

কঠোর লকডাউন শুরু হতেই দুধ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন পাবনা ও সিরাজগঞ্জের খামারিরা। দেশের অন্যতম গরুর দুধ উৎপাদনকারী এই এলাকার খামারিরা এখন পানির দরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্থানীয় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনা কমিয়ে দেওয়ায় এবং ছানা কারখানা ও মিষ্টির দোকানগুলো বন্ধ থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক খামারিই এখন উৎপাদিত দুধ ভ্যানে তুলে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে ফেরি করে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। উপরন্তু হঠাৎ করেই গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের লোকসান আরও বেড়ে গেছে।

পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ এলাকার ২৫ হাজারের বেশি খামারে প্রতিদিন পাঁচ লাখ লিটারের বেশি গরুর দুধ উৎপাদিত হয়। প্রচুর দুধ উৎপাদিত হওয়ায় এ এলাকা থেকে মিল্কভিটা, আড়ং দুধ, প্রাণ ডেইরি, ফার্মফ্রেশ, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরিসহ কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে খোলাবাজারে বিক্রি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলোর দুধ সংগ্রহের পরিমাণ প্রতিদিন তিন লাখ লিটারের মতো। বাকি দুধ স্থানীয় ঘোষ বা দুধ ব্যবসায়ীরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে থাকেন। এ ছাড়া স্থানীয় ঘি, ছানা ও মিষ্টিজাত কারখানাতেও প্রচুর দুধ প্রয়োজন হয়।

কোনো কোনো খামারি ভ্যানে করে দুধ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে দুধ বিক্রি করছেন। এ দুধ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে। খামারিরা জানান, এ দামে দুধ বিক্রি করে তাঁদের লিটারে ২০ থেকে ৩০ টাকা লোকসান হচ্ছে।

খামারিরা জানান, গত এপ্রিলের শুরুতে করোনাকালীন বিধিনিষেধ শুরু হলেও খামারিরা ভালো দামেই দুধ বিক্রি করে আসছিলেন। এর মধ্যে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে খামারিরা সর্বোচ্চ চড়া দামে দুধ বিক্রি করেছেন। ওই সময়ে টানা দেড় থেকে দুই মাস ধরে খামারিরা ৫০ থেকে ৬০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করেছেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই দুধের দাম পড়তে শুরু করে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, ওই সময় থেকে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমাতে শুরু করে। আর বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) কঠোর লকডাউন শুরু হতেই প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই দুধ কেনা কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আবার দুধ সংগ্রহ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। একই সঙ্গে ছানার কারখানা ও মিষ্টির দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খামারিদের দুধ বিক্রির আর কোনো জায়গা নেই বললেই চলে।

বাধ্য হয়ে খামারিরা দুদিন ধরে উৎপাদিত দুধ খোলাবাজারে নিয়ে আসছেন। কিন্তু খোলাবাজারে এত দুধ চলে আসায় তার বেশির ভাগই অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। এতে কোনো কোনো খামারি ভ্যানে করে দুধ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে দুধ বিক্রি করছেন। এ দুধ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে। খামারিরা জানান, এ দামে দুধ বিক্রি করে তাঁদের লিটারে ২০ থেকে ৩০ টাকা লোকসান হচ্ছে।

বাঘাবাড়ী মিল্কভিটার আওতাধীন সাঁথিয়া উপজেলার বোয়াইলমারী প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি ও সাঁথিয়া ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘কিছুদিন আগেও মিল্কভিটা আমাদের সমিতির সব দুধ নিত। অথচ এখন তারা দুধ নেওয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। এতে আমাদের সমিতির ১৩২ জন সদস্য চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন। খোলাবাজারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে।’

লকডাউনে প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনা বন্ধ রেখেছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠানের দুদিন ধরে বন্ধ ফটক। শুক্রবার বেড়ার আমাইকোলা এলাকায়
প্রথম আলো

বেড়ার মোহনগঞ্জ বাজার এলাকায় ভ্যানে দুধ বিক্রি করছিলেন আবদুর রহমান নামের এক খামারি। তিনি জানান, কিছুদিন আগেও তিনি পিউরামিল্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ৫০ থেকে ৫২ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করেছেন। অথচ দুদিন ধরে সেই প্রতিষ্ঠানটি দুধ নিচ্ছে না। তাই ভ্যানে দুধ নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করছেন। এতে প্রতি লিটার ২০ থেকে ৩০ টাকা দাম পাওয়া যাচ্ছে। বেড়া পৌর এলাকার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি মাহফুজা মীনা বলেন, ‘আমার খামারে প্রতিদিন ৩০০ লিটার দুধ হয়। অথচ কোনো প্রতিষ্ঠানে এখন দুধ বিক্রি করতে পারছি না। বাজারে প্রতি লিটারের দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে আবার গোখাদ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে।’

জানতে চাইলে সাঁথিয়ার আমাইকোলা গ্রামের দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান পিউরামিল্কের স্বত্বাধিকারী আবদুর রউফ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ঢাকায় প্রতিদিন চার হাজার লিটারের মতো দুধ পাঠাতাম। কিন্তু লকডাউনের কারণে ঢাকায় এখন আর দুধের চাহিদা নেই। তাই দুদিন ধরে দুধ সংগ্রহ বন্ধ রেখেছি।’ মিল্কভিটার বাঘাবাড়ী কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে বেশি দুধ নিলেও এখন আমরা এক লাখ লিটারের বেশি দুধ নিতে পারছি না। লকডাউনের জন্য আমাদের দুধ সংগ্রহ কমেছে।’

বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা গৌরচন্দ্র সাহা বলেন, লকডাউনের কারণে দুধের দাম কমে যাওয়ায় খামারিদের লোকসান হচ্ছে। তাঁরা দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনার অনুরোধ করে যাচ্ছেন। তবে লকডাউন পরিস্থিতি শিথিল হলেই খামারিরা আবারও আগের মতো দুধের দাম পাবেন বলে তাঁরা আশা করছেন।