ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস, মাকে ফিরে পেল মেয়ে
রাতে একটুও ঘুমাতে পারেননি জরিনা বেগম। ভোর হতে না হতেই বিছানা ছাড়েন। এরপর বাসা আর রাস্তা, রাস্তা আর বাসা—কতবার যে হাঁটাহাঁটি করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। প্রায় দুই বছর পর হারিয়ে যাওয়া মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে তাঁর। অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না। কখন আসবে ফাইনুর। শেষ পর্যন্ত বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার এসে থামল বাসার সামনের রাস্তায়। ছুটে গেলেন তিনি। গাড়ির দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন জরিনা বেগম। এই কান্না আনন্দের।
গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম নগরের অলংকার-মুন্সিপাড়া এলাকার দিদার কলোনির সামনের রাস্তায় মা-মেয়ের পুনর্মিলনের দৃশ্য ছিল এমনই। ২০ মাস আগে মেয়ে ফাইনুরকে (১০) ঢাকার উত্তরার এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজে পাঠান ভোলার চরফ্যাশনের দম্পতি মো. হানিফ ও জারিনা বেগম। সেই বাসায় মারধরের কারণে এক মাসের মাথায় পালিয়ে যায় সে। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ ছিল না শিশুটির।
ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. সোহেল রহমানের সহযোগিতায় সপ্তাহ খানেক আগে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের খোঁজ পান জরিনা বেগম। শুক্রবার রাতে ফাইনুরসহ পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন সোহেল। গতকাল ফাইনুরকে তার মা-বাবার হাতে তুলে দেন তিনি।
ফাইনুরকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া গেল তা শোনা যাক সোহেল রহমানের স্ত্রী সোহানা আফরোজের মুখ থেকে: ‘দেড় বছর আগে একদিন সন্ধ্যায় উত্তরার এক দোকানের সামনে মেয়েটিকে কাঁদতে দেখেন আমার বড় বোন শারমিন আফরোজ। তখন মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, মারধরের কারণে এক বাসা থেকে পালিয়েছে সে। এরপর মেয়েটিকে তাঁর (শারমিন) বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয়। তখন শারমিন আপা তাকে ঘরে নিয়ে যান।’

সোহানা আফরোজ বলেন, ‘উত্তরায় শারমিন আপার বাসায় যাওয়ার পর চাপা স্বভাবের ফাইনুর তখন নিজের নাম ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছিল না। ওই বাসায় ফাইনুরকে টুম্পা নামে ডাকা হতো। আপার বাসায় এক বছর থাকার পর কয়েক মাস আগে আমার বাসায় নিয়ে আসি ফাইনুরকে। আমার বড় মেয়ে হুমায়ারার সঙ্গে তার ভাব হয়। দুজন সমবয়সী। মাস খানেক আগে ফাইনুর তার বাবা-মা ও এক মামার নাম মনে করতে পারে, কিন্তু ঠিকানা বলতে পারছিল না। কয়েক দিন পর হুমায়ারাকে বলে তাদের বাড়ি কোনো এক লঞ্চঘাটের পাশে। গ্রামের নাম ঘোষের হাট। এরপর ফাইনুরের পরিবারকে খুঁজে পাওয়ার পথ পাই আমরা।’
সোহেল রহমান বলেন, গত ২৯ ডিসেম্বর ফাইনুর, তার বাবা ও মায়ের নাম, ঘোষের হাট এলাকা কোথায় এসব লিখে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। এরপর অনেকে তাঁকে নিশ্চিত করলেন এলাকাটি ভোলায়। তবে ঘোষের হাট গ্রাম নয়, ঘাটের নাম। ফাইনুরের গ্রামের নাম নীলকমল। এভাবে ফেসবুকে খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল তার মামা মো. খালেককে। ফেসবুকের মাধ্যমে ফাইনুরের ছবি খালেককে দেখানো হয়। নিশ্চিত হওয়া যায় সে তাঁর ভাগনি। ফাইনুরও ছবি দেখে নিশ্চিত করে খালেক তাঁর মামা।
অবশ্য ঠিকানা খুঁজে পেলেও ফাইনুরের বাবা-মাকে ভোলায় পাওয়া যায়নি। ছয় মাস আগে মৎস্যজীবী মো. হানিফ পরিবার নিয়ে ভোলা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যান। সপ্তাহ খানেক আগে খালেক তাঁদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। এরপর হানিফ ও জরিনার ছবি পাঠানো হয় সোহেল রহমানের ফোনে। ওই ছবি দেখে ফাইনুর তার মা-বাবাকে নিশ্চিত করে। এরপর ঘটে মা-মেয়ের পুনর্মিলন।
নিজ বাসায় মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে জরিনা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, মেয়েকে কোথায় খুঁজব? কিন্তু মায়ের মন তো মানে না। যখন জানলাম ফাইনুরকে পাওয়া গেছে। আল্লাহর কাছে শোকর করেছি। এই ভালো মানুষগুলোর হাতে না পড়লে আমার মেয়েকে কি পেতাম?’
জরিনা বেগমের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ফাইনুর দ্বিতীয়। বড় বোনকে পেয়ে ছোট বোন মাইনুর গলা জড়িয়ে ধরে। যখন বাড়ি থেকে ঢাকায় কাজে যাচ্ছিল, তখন ছোট ভাই সজীবের বয়স ছিল দুই মাস। বড় ভাই শরীফ এখন চা-দোকানে কাজ করে। দিদার কলোনিতে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় এক কক্ষের একটি ঘরে থাকে পুরো পরিবার।
ফাইনুর বলে, ‘আমাকে অনেক মারত ওই বাসায়। একদিন পালিয়ে যাই। তখন শারমিন আন্টির সঙ্গে দেখা হয়। এখন মা-বাবাকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।’
ফাইনুরের বাবা মো. হানিফ বলেন, ‘অভাবের সংসারের কারণে মেয়েকে ঢাকায় একজনের বাসায় কাজের জন্য পাঠাই। একদিন ওই বাসা থেকে ফোন আসে। বলে, তোমার মেয়েকে তুমি এখান থেকে চুরি করে নিয়ে গেছ। তোমার বিরুদ্ধে মামলা করব। এত বড় ঢাকায় কোথায় মেয়েকে খুঁজব? এখন এই ভাইয়ের (সোহেল) কারণে মেয়েকে ফিরে পেলাম।’
সোহেল রহমান বলেন, ‘আমার নিজেরও মেয়ে আছে। আমি কেবল একটি হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে তার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। সেটা দিতে পেরে ভালো লাগছে।’